You are here
Home > Blog > ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই নিয়ে সাধারণ কিছু তথ্য

ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই নিয়ে সাধারণ কিছু তথ্য

ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই হলো কোনো একটি এলাকার বিশেষ কোনো পণ্য নির্দেশক চিহ্ন। আর ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য বলতে কোনো একটি এলাকার বিশেষ সেই পণ্যকে নির্দেশ করে যে পণ্যটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য, সুনাম, গুনাবলি এবং বিশেষত্ব উক্ত এলাকার সাথে গভীর ভাবে সম্পর্কিত এবং উক্ত এলাকার পরিচয় বহন করে। কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে সেই পণ্যের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হয়, যার মাধ্যমে পণ্যটির উৎপাদনকারি এলাকা, উৎপাদক এবং ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া অধিকার এবং বিশেষ নিরাপত্তা লাভ করে। জিআই এর মাধ্যমে পণ্যের সঠিক ব্র‍্যান্ডিং নিশ্চিত হয়, এতে ক্রেতারাও বিশেষ সেই পণ্যটিকে সহজে আলাদা করতে পারে। 

হস্তশিল্প, কৃষি পণ্য, শিল্প পণ্য, উৎপাদিত পণ্য, বিশেষ খাদ্যদ্রব্য, পানীয় ইত্যাদি জিআই হতে পারে। 

জিআই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো-

  • দেশের কোন এলাকায় সহজে পাওয়া যায়, এর পেছনে ওই এলাকার কী কী ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য  রয়েছে, 
  • পণ্যগুলোর কী বিশেষত্বের জন্য অন্য পণ্য বা অন্য এলাকায় উৎপন্ন সমগোত্রীয় পণ্য থেকে আলাদা 
  • এসব পণ্য উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট এলাকার জলবায়ু, মাটি ও পানি কতটা উপযোগী, 
  • কোনো জনগোষ্ঠী বা কোনো সংগঠন বিশেষ এ পণ্যের ওপর নির্ভরশীল কি না,
  • তারা কত সময় ধরে নির্দিষ্ট এ পণ্য থেকে কী পরিমাণ অর্থ আয় করেছে, 
  • পণ্যটি ওই জনগোষ্ঠী বা সংগঠনের আয়ের একমাত্র উৎস কি না,
  • ঐতিহ্যবাহী ওই পণ্য দেশে-বিদেশে কতটা সুনাম অর্জন করেছে, কতটা জনপ্রিয়, এর রপ্তানি সম্ভাবনা কতোটা, 
  • পণ্যটি ওই অঞ্চলের ঐতিহ্য সংস্কৃতির সাথে কতটা জড়িত,

  • সংশ্লিষ্ট এলাকার কারিগররা পণ্যটি কতটা নিখুঁতভাবে তৈরি করতে পারে, যেমনটা অন্য এলাকার কারিগররা পারে না এবং 
  • এলাকাটি ভ্রমণের উপযোগী কি না, যাতায়াত ব্যবস্থা কতটা উপযোগী ইত্যাদি যাচাই করা হয়।

জিআই নিয়ে আমাদের অবস্থানঃ

WIPO এর একটা রিপোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সাল পর্যন্ত –

সর্বোচ্চ জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত দেশ হলো জার্মানি, যাদের জিআই পণ্য তখন পর্যন্ত ছিল ১৫,৫৬৬টি! 

দ্বিতীয় হলো চীন, জিআই পণ্য ৭২৪৭টি!

৩য় হলো হ্যাঙ্গেরি, জিআই পণ্য ৬৬৮৩টি! 

৪র্থ চেজ রিপাবলিক, জিআই পণ্য ৬২৮৫টি! 

৫ম বুলগেরিয়া, জিআই পণ্য ৬০৩৮টি! 

৬ষ্ঠ ইতালি, জিআই পণ্য ৬০১৫টি!

৭ম পর্তুগাল, জিআই পণ্য ৫৯৯৮টি!

আর বৃহত্তম মধ্য আয়ের দেশগুলোর মাঝে সর্বোচ্চ জিআই ট্যাগ রয়েছে ভারতের দখলে, ২০১৮ সালের সেই রিপোর্টে ৩৩০টি জিআই পণ্যের কথা থাকলেও, বর্তমানে আমরা জানি ভারতের ৪২১টি পণ্য জিআই স্বত্ব পেয়ে গিয়েছে। মধ্য আয়ের বৃহত্তম দেশের মাঝে ২য় সর্বোচ্চ জিআই ব্রাজিলের দখলে, ২০১৮ সালে তাদের জিআই ছিল ৬৮টি। 

আমাদের মাত্র ১১টা জিআই! ভাবতে পারেন কতটা পিছিয়ে আছি! আমাদের প্রধান সমস্যা আসলে, আমরা জানার চেষ্টা করি কম, প্রচার করি কম, আর চেষ্টা শুরুর আগেই হাল ছেড়ে দেই।

এই যে কিছু ব্যাপার ভেবেই আমরা আগেই পিছিয়ে যেতে চাচ্ছি এখনো। যেমনঃ এই পণ্য অন্য দেশের জিআই আমরা পাব না, ১০০-৫০০ বছরের ঐতিহ্য হতে হবে, দেশের বাইরে খুব বেশি জনপ্রিয় হতে হবে,  কাঁচামাল ১০০ ভাগ খাঁটি দেশি হতে হবে, আমদানিকৃত হওয়া যাবে না ইত্যাদি অনেক কিছুই। 

কিন্তু আমি জার্মানির জিআই পণ্যের সংখ্যা দেখে ভাবছি, ১৫ হাজারের বেশি জিআই কীভাবে হয় জার্মানির! ওরা কাঁচামাল বা উৎপাদনের দিকে কয়েক শত বছর ধরে এতোটাই সমৃদ্ধ তাহলে? অনেক প্রশ্ন এমন জাগছে মনে। আমার মনে হয়েছে, সমৃদ্ধির চেয়েও বেশি হচ্ছে ওরা সচেতন, নিজেদের পণ্য এবং ঐতিহ্যের ব্যাপারে যত্নশীল। 

যাই হোক, আমাদের জিআই পণ্য ১১টা থেকে বেড়ে কতো পর্যন্ত হতে পারে এটার কাউন্টিং শুরু হবে আমাদের প্রেজেন্ট করতে পারার উপর। আমরা যত বেশি স্ট্রংলি আমাদের পণ্যকে তুলে ধরতে পারব, ডকুমেন্ট তৈরি করতে পারব তত বেশি পণ্যের জিআই ট্যাগ প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হবে। 

কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ব্র‍্যান্ড, কোম্পানি বা দোকানের নামে কী জিআই হতে পারে?

উত্তর হলো- না!

এখানেই ট্রেডমার্ক এবং জিআই এর পার্থক্য।

জিআই হতে হলে অবশ্যই কোনো পণ্যের আঞ্চলিক বিশেষত্ব এবং অবদান থাকতে হবে। কোনো একটা অঞ্চল বা দেশের নামেই শুধু জিআই হতে পারে।

আর কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ব্র‍্যান্ড, কোম্পানি বা দোকান যদি নিজেদের বিজনেসকে আরও সিকিউরড করতে চায়, যেন সমজাতীয় অন্যান্য বিজনেসের থেকে তাদের ভ্যালু আলাদা হয় তাদের ব্র‍্যান্ড নামের কারণে, তবে তারা আবেদন করতে পারবে ট্রেডমার্কের জন্য, জিআই এর জন্য না।

যেমন ধরেন, পুরান ঢাকার “হাজির বিরিয়ানি” খুবই বিখ্যাত একটি ব্র‍্যান্ড হয়ে গেছে বিরিয়ানির জন্য। তাদের কিন্তু ঢাকার বাইরে কোনো ব্রাঞ্চ নেই, কিন্তু দেশের প্রত্যেকটা এলাকায় অসংখ্য বিরিয়ানির দোকান এই নামে আছে, কিন্তু বিরিয়ানির স্বাদ কিন্তু পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানির মতো না। এখন পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানি তাদের ব্র‍্যান্ড ইমেজ বজায় রাখতে এবং তাদের নামের কপি ঠেকাতে ট্রেডমার্কের আবেদন করতে পারে। ট্রেডমার্ক রেজিষ্ট্রেশন পেয়ে গেলে তাদের বিরিয়ানির প্যাকেটে তারা ® চিহ্ন ব্যবহার করতে পারবে, যা দ্বারা কাস্টমার সহজেই বুঝবে এটাই আসল হাজির বিরিয়ানি।

এখন যদি শুধু হাজির বিরিয়ানির কথা উল্লেখ না করে, “পুরান ঢাকার কাচ্চি বা বিরিয়ানি” বলি, আর এর সাথে যদি পুরান ঢাকার নিজস্বতা, বিশেষত্ব, বহু লোকের কর্মসংস্থান, বিশাল অংকের লেনদেন ইত্যাদি আমরা দেখাতে পারি, তবে এটা জিআই আবেদনের যোগ্যতা অর্জন করলেও করতে পারে।

আবার ধরেন, ময়মনসিংহের মালাইকারি সারাদেশে খুব বিখ্যাত। ময়মনসিংহে প্রথম মালাইকারির প্রচলন করেছিলেন কিন্তু একজন, তিনি সুধীর ঘোষ। প্রথমে তার দোকান থেকে মালাইকারির প্রচলন হলেও, ময়মনসিংহের প্রত্যেকটা মিষ্টির দোকানে এখন মালাইকারি পাওয়া যায় এবং প্রত্যেকটারই স্বাদ অসাধারণ। মালাইকারিকে কেন্দ্র করেই ময়মনসিংহে মিষ্টির দোকানগুলোতে বিশাল কেনাবেচা হয়, শহরের বাইরে থেকে কেউ এলে মালাইকারি মিষ্টি নিয়ে যায়, এখন অনলাইনের মাধ্যমে ঢাকায়ও মালাইকারি ডেলিভারি দেন অনেকেই। এটি তাই বলা যায় ময়মনসিংহের অর্থনীতিতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। 

সুধীর ঘোষ প্রথমে শুরু করলেও সারাদেশে কিন্তু সুধীর ঘোষের মালাইকারি নামে পরিচিত হয় নি, বরং ময়মনসিংহের নামটাই মালাইকারির সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং একটা অঞ্চলভিত্তিক বিশেষত্বও এর সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই “ময়মনসিংহের মালাইকারি” নামে আমরা জিআই এর আবেদন করতে পারি।

কুমিল্লার রসমালাই এর ক্ষেত্রেও তাই। কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাই বিখ্যাত হলেও, এখন কুমিল্লার প্রত্যেকটা মিষ্টির দোকানের রসমালাই এর সাথেই কুমিল্লার রসমালাই এর খ্যাতি, নাম, যশ যুক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই কুমিল্লার রসমালাই নামে জিআই আবেদন আমরা করতে পারি।

আমি যাস্ট কয়েকটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। আপনারা নিজেদের অঞ্চলের সম্ভাব্য জিআই পণ্যগুলোর সাথে এই দিকটা মিলিয়ে নিতে পারেন।

ভারতের জিআই লিস্টে প্রথমে ‘হায়দ্রাবাদি হালিম’ দেখে খুব এক্সাইটেড ফিল করেছিলাম। কারণ এর আগে কনফিউশন ছিল রান্না করা খাবার জিআই হতে পারে কীনা তা নিয়ে। এরপর ভারতের জিআই ফুড লিস্ট নিয়ে সার্চ করে আরও ভালো লাগছিল চিন্তা করে যে, আমাদের তাহলে আঞ্চলিক খাবার, পিঠা, মিষ্টি ইত্যাদি কতো বেশি সম্ভাবনাময় জিআই হওয়ার ক্ষেত্রে!

তবে যখন দেখলাম ‘হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি’ তাদের হালিমের থেকেও সারাবিশ্বে অনেক বেশি জনপ্রিয় হওয়ার পরও জিআই পায় নি আবেদন করে, তখন হতাশ হয়েছিলাম। কারণ হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি ইন্ডিয়ান খাবার হিশেবে সারাবিশ্বে এক নামে পরিচিত, বিশ্বের সব দেশেরই ভারতীয় রেস্টুরেন্টগুলোর অন্যতম আইটেম এটা। তারপরও এটা জিআই কেনো পায় নি, জানেন?

কারণ যে এসোসিয়েশন আবেদন করেছিল এই বিরিয়ানির জিআই এর জন্য, তাদের কাছে যে ডকুমেন্টস এবং ঐতিহাসিক দলিল চাওয়া হয়েছিল, তা তারা আর দেয় নি।

জিআই এর ক্ষেত্রে এই ডকুমেন্টসের গুরুত্ব সীমাহীন। তাই আমাদের সম্ভাব্য জিআই পণ্য গুলো ধরে ধরে তথ্য সংগ্রহ এবং ডকুমেন্টস তৈরির দিকে ফোকাস করতে হবে সবার আগে।

ভারতের জিআই লিস্ট দেখেই বুঝতে পারছি আমাদের অসংখ্য অসংখ্য দেশি খাবার জিআই হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

যেমনঃ চটপটি বাংলাদেশের একদম নিজস্ব খাবার এবং স্ট্রিট ফুড হিশেবে অনেক বেশিই জনপ্রিয়। এটার উপকরণও সবই একদম দেশীয়। তাই নিঃসন্দেহে চটপটি আমাদের জিআই হতে পারে৷

আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠাগুলো একদম দেশে উৎপাদিত চালের গুড়া, দুধ, নারকেল, গুড়, ইত্যাদির ব্যবহারে তৈরি হয়, তাই অসংখ্য পিঠা অঞ্চলভেদে জিআই পেতে পারে। খাজা, গজা, নাড়ু, সন্দেশ, মন্ডা ইত্যাদির মতো মিষ্টান্ন অসংখ্য আছে যেগুলোর আঞ্চলিক বিশেষত্ব আছে। আমাদের খাবার, পিঠা আর মিষ্টির মাঝেই আসলে অনেক অনেক সম্ভাব্য জিআই আছে।

তবে প্রশ্ন হতে পারে, এসব খাবারের জিআই ট্যাগ নিয়ে কী লাভ, এগুলো তো রপ্তানি করা যাবে না? 

জিআই তো আসলে শুধু রপ্তানির জন্যই না। এটা গ্লোবাল ব্র‍্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করে, রপ্তানির সুযোগ বাড়ায়। কিন্তু এই ব্র‍্যান্ডিং সরাসরি রপ্তানি করা ছাড়াও অনেক কাজে লাগে।

যেমন ধরেনঃ বাংলাদেশে পর্যটক আসলে কী খাবার খুঁজবে বলেন তো? বাংলাদেশের যেসব খাবার গ্লোবালি পরিচিত, জনপ্রিয়, বিখ্যাত তাই তো খুঁজবে, তাই না?

আবার ধরেন, লন্ডনে প্রচুর বাঙালি থাকে, বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্টও তাই প্রচুর আছে। সেগুলোতে অনেক বিদেশিরাও খায়। সেগুলো রেস্টুরেন্টে গিয়ে মানুষ কী ধরনের আইটেম আগে খুঁজবে, অবশ্যই যেগুলো বাংলাদেশের জনপ্রিয় খাবার তাই খুঁজবে।

আমরা যে চাইনিজ, কোরিয়ান, ওয়েস্টার্ন বিভিন্ন খাবারের প্রতি আসক্ত এগুলো অবশ্যই তো ব্র‍্যান্ডিং এর কারণেই!

তো জিআই ট্যাগ পাওয়া খাবারের ব্র‍্যান্ডিং কী কাজে লাগবে না আমাদের ক্ষেত্রেও! বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী এগুলো অবদান রাখবে না? কী মনে হয় আপনাদের?

জিআই পণ্য নিয়ে আমাদের মাঝে এখন সবচেয়ে কমন যে কনফিউশন কাজ করছে তা হলো-

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে আমাদের অনেক ঐতিহ্যবাহী পণ্যের মিল থাকায় এবং তারা জিআই নিয়ে অনেক বছর আগে থেকে সিরিয়াসলি কাজ করায় অনেক জিআই স্বত্ব ইতিমধ্যেই ভারতের দখলে চলে গিয়েছে। এই পণ্যগুলো আমাদেরও ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধির সাথে যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে থাকায় সেগুলো আমাদেরও জিআই হতে পারত, কিন্তু আমরা সুযোগ হারিয়েছি। ব্যাপারটা এমনই ভাবছি সবাই আর হতাশ হচ্ছি।

যেমন সবাই চিন্তা করছি এখন যে, নকশিকাঁথা, মণিপুরী ইত্যাদির জিআই তো ভারত নিয়ে নিয়েছে, আমরা তাহলে কীভাবে নিব?!

কিন্তু আসলে আমাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই একদমই। কারণ হলো জিআই ট্যাগ দেয়া হয় অঞ্চলভিত্তিক বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষত্ব অনুযায়ী। একই পণ্য একের অধিক দেশের জিআই পণ্য হতে পারে যদি অঞ্চলভিত্তিক বৈশিষ্ট্য বিশেষত্ব আলাদা হয়৷

যেমন ধরেন- জামদানির জিআই ট্যাগও প্রথমে ভারত নিয়েছিল “উপাধা জামদানি” নামে। এরপর বাংলাদেশের পৃথিবী বিখ্যাত “ঢাকাই জামদানি’র জিআই প্রাপ্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এরপর অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যখন প্রমাণিত হলো যে, ঢাকাই জামদানি নিজ গুনে বিশেষত্বে অনন্যা, পৃথিবীর কোথাও আর শীতলক্ষ্যা তীরের জামদানির গুনাবলি অর্জন করা সম্ভব নয়। তখন কিন্তু বাংলাদেশের জামদানিও ” ঢাকাই জামদানি” নামে আলাদা জিআই স্বত্ব অর্জন করেছে।

গতবছর জিআই পাওয়া আমাদের রাজশাহী আর চাপাইনবয়াবগঞ্জের ফজলি আমের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল, যেহেতু ফজলি আমের জিআই ট্যাগও ভারত আগেই নিয়ে নিয়েছিল। তারপরও কিন্তু ফজলি আম আমাদের জিআই হয়েছে।

মূল বিষয় হলো যে, জিআই পণ্য যে সব অঞ্চলভিত্তিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়,  সেগুলো অঞ্চলভেদে পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে, কৃষি আর তাঁতের উপর অঞ্চলভিত্তিক জলবায়ু, বাতাসের আর্দ্রতা ইত্যাদি অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই আমাদের দেশেরই এক অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষি এবং তাঁতপণ্য অন্য অঞ্চল থেকে আলদা হয়। তাই ভারতে যেসব পণ্য জিআই হয়েছে, সেগুলো আমাদের দেশের জিআই হতে পারবেনা এমন কোনো কথা নেই। আমাদের দরকার শুধু সঠিকভাবে আমাদের পণ্যগুলোর বৈশিষ্ট্য, বিশেষত্ব আলাদাভাবে তুলে ধরা।

তাই যারা মণিপুরী নিয়ে কাজ করছেন, নির্দ্বিধায় আপনাদের পণ্যকে জিআই পণ্য হিশেবে স্বীকৃত করার জন্য চেষ্টা করতে পারেন। এমনকি আমার মনে হয়, মণিপুরী শাড়ি, মণিপুরী শাল এবং মণিপুরী মাফলারও আলাদা আলাদা ভাবে জিআই ট্যাগ পাওয়ার যোগ্য।

★ “সিলেটি মণিপুরী” কেনো জিআই হওয়া উচিত?

এই শিরোনামে ঢাকার বনশ্রীতে ইভেন্ট করেছিলেন Rehmuma Hossain আপুরা। সেখানে সব ধরণের মণিপুরী পণ্যের প্রদর্শনী হচ্ছে, সবাই মণিপুরী শাড়ি, শাল, মাফলার ইত্যাদি পরে ইভেন্টে অংশগ্রহণ করছেন। এটা একটা দারুণ উদ্যোগ। আজকের ইভেন্টের মাধ্যমে আশা করা যায় মণিপুরী পণ্যের জিআই হওয়া নিয়ে সবার কনফিউশন দূর হবে, কারো মাঝে আর দ্বিধা থাকবে না এবং সবাই মিলে উদ্যোগী হবে মণিপুরী পণ্যের জিআই আবেদন করার উপযোগী ডকুমেন্টস তৈরি করার জন্য।

প্রথমেই আমরা যে ব্যাপারটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম, তা হলো ভারত মণিপুরীর জিআই নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আসলে –

* প্রথমত মণিপুরী শাড়ি নামে ভারতের কোনো জিআই নেই। এছাড়াও ভারতের মণিপুর রাজ্যের যে কয়টা ফেব্রিক জিআই পেয়েছে সেগুলোর সাথে সরাসরি মণিপুরী নামেরও উল্লেখ নেই,

* ডিজাইনেও অনেক ভিন্নতা আছে,

* আর কোয়ালিটির ভিন্নতা তো থাকবে এটা মাস্ট যেহেতু দুইটা দুই অঞ্চলের তাঁতে বোনা। হাতে বোনা তাঁতের উপর আবহাওয়া, জলবায়ু, পানি, বাতাসের আর্দ্রতা ইত্যাদির ভূমিকা অনেক বেশি।

তাই বলা যায়, আমাদের দেশের সিলেটি মণিপুরী শাড়ি, শাল, মাফলার ইত্যাদি অবশ্যই জিআই পেতে পারে। শুধু দরকার এখন এর জার্নালের জন্য প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক দলিল, আঞ্চলিক বিশেষত্ব, উৎপাদনকারীদের তালিকা, লেনদেনের পরিমাণ, ছবি, উৎপাদন অঞ্চলের মানচিত্র ইত্যাদি তৈরিতে কাজ করা, তারপর আবেদন করা।

জিআই এবং অঞ্চলভিত্তিক অর্থনীতি 

দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধি লাভ করে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি এখন মূলত বড় বড় শহরকেন্দ্রিক। দক্ষতা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। আরও স্পেসিফিক ভাবে বললে বলা যায়, ঢাকামুখী হচ্ছে। তাই ঢাকার বর্তমান অবস্থা বসবাসের কতোটা উপযোগি তা আমরা সবাই জানি। এর সমাধান আছে শুধু মাত্র জেলা উপজেলা কেন্দ্রিক অর্থনীতির আরও সমৃদ্ধির মাঝে, যেন জেলা উপজেলা থেকে খুব বেশি মানুষকে ঢাকায় আসতে না হয়। আর এদিকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করবে অঞ্চলভিত্তিক জিআই পণ্য।

একটা অঞ্চলের নামে যখন একটা জিআই পণ্য হবে, তখন সেই পণ্যটাকে ঘিরে সেই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আসবে।

যেমন ধরেন, ময়মনসিংহের মৃৎশিল্প যদি জিআই হয়, তাহলে স্পেসিফিক ভাবে দেশে বিদেশে এই অঞ্চলের মাটির জিনিসের ব্র‍্যান্ডিং হবে, বিক্রি বাড়তে থাকবে। এর ফলে এখানকার পাল পরিবারদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হবে। অনেক পাল যারা মৃৎশিল্পের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, তারাও আবার কাজে ফিরবে। তাদের ছেলেমেয়েদেরকে ভালো স্কুল কলেজে দিতে পারবে, উপার্জন বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই তারা কেনাকাটাও বেশি করবে। এমন করে ৬৪ জেলার ৬৪টি মৃৎশিল্পের আলাদা আলাদা জিআই প্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে।

এভাবে জিআই প্রাপ্তি এবং মৃৎশিল্পের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে একে ঘিরে অসংখ্য উদ্যোক্তাও তৈরি হবে।

এর ফলে একটা সার্কুলার ওয়েতে তারা অঞ্চলভিত্তিক অর্থনীতিতে পজিটিভ প্রভাব ফেলতে থাকবে। এক সময় এভাবে দেখা যাবে  প্রতিটি অঞ্চলেই অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সেখানেই তৈরি হচ্ছে, তাদের আর ঢাকায় যেতে হচ্ছে না। সর্বোপরি এটা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখবে। সংক্ষেপে এখানে একটা পণ্যের উদাহরণ দিয়ে যাস্ট জেলা ভিত্তিক জিআই পণ্যের গুরুত্বটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত প্রদেশভিত্তিক জিআই এর উপর এজন্যই এতো জোর দিচ্ছে। তাদের প্রত্যেকটা প্রদেশের সরকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে এখন এ নিয়ে যে, কোন প্রদেশ কতো বেশি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি নিতে পারে। আমাদের ৬৪ জেলার ৬৪টা জেলা প্রশাসনও এভাবে এগিয়ে আসলে এক সময় প্রত্যেকটা অঞ্চলে অসংখ্য জিআই পণ্য থাকবে এবং জিআই পণ্য কেন্দ্রিক বিশাল বিশাল মার্কেটপ্লেস গড়ে উঠবে বলেই আশা করা যায়। এটি দেশের রপ্তানি বানিজ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে।

★ জিআই নিয়ে কাজ করে আমাদের কী লাভ?

আমরা যারা এ বছর জানুয়ারি থেকে জিআই পণ্য নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছি, তাদের সবাই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের আসলেই জিআই নিয়ে কাজ করে কোনো লাভ নেই। মানে, ব্যক্তিগত কোনো লাভ একদমই নেই। দেশের জিআই পণ্য বৃদ্ধি পেলে সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য লাভ এবং কোনো পণ্য জিআই হলে সেটার উৎপাদনকারি এবং বিক্রেতাদের লাভ৷

মূলত আমরা ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি) নামের একটি ট্রাস্টের হয়ে কাজ করছি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। যে কোনো ট্রাস্ট মানেই সেটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, তাই এর কার্যক্রমে লাভ খোঁজার মানে নেই।

আর একান্তই যদি আমাদের লাভের কথা বলতে হয়, তবে বলব দেশের জন্য যে কোনো কাজ করায় যে আত্মতৃপ্তি মিলে এটা আর অন্য কিছুতে পাওয়া সম্ভব না। আর যারা এই আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায়, তাদের নিঃস্বার্থ কাজের মাধ্যমেই দেশ এগিয়ে যায়। তাই জিআই নিয়ে এখন যারা কাজ করছে, আর ভবিষ্যতে যারা করবে সবাইকে ব্যক্তিগত লাভের চিন্তা বাদ দিয়েই কাজ করতে হবে।

★ বাংলাদেশের জিআই পণ্য নিয়ে আমাদের চেষ্টার ১০০ দিন – “১জানুয়ারি, ২০২৩ থেকে ১০ এপ্রিল ২০২৩”

ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ স্যারের দিক নির্দেশনায় জিআই নিয়ে আমরা এ বছর কিছু সাধারণ মানুষ, কিছু দেশি পণ্যের উদ্যোক্তারা চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রথম ১০০ দিনের জার্নিটা অসম্ভব রকমের সফল হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। কিছু সংখ্যক সাধারণ মানুষ প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জিআই পণ্য নিয়ে কাজ করছে, লিখছে, চিন্তা করছে, এটা বিশাল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলা যায়। 

২০১৩ সালে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক আইন পাস হওয়ার পর থেকে এই ১০ বছরে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে ১১টি পণ্য। আর আমাদের এই ১০০ দিনের চেষ্টার মাধ্যমে আরও ১১টি সম্ভাব্য জিআই পণ্যের ড্রাফট ডকুমেন্ট শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডিপিডিটিতে জমা দিতে পেরেছি। দেশের জিআই পণ্য খুব শীঘ্রই ১১টি থেকে ১১০০ হবে, তাই প্রত্যাশা করি। 

জানুয়ারির ১তারিখ Razib Ahmed  স্যারের সাথে যখন আমি জিআই নিয়ে শেয়ার করছিলাম, সেদিন চিন্তা করিনি এতো দ্রুত আমরা এতোটা পরিবর্তন ঘটাতে পারব। তবে স্যার যে কাজে সিরিয়াস হোন সেটা এভাবেই সফলতা পায়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। সেই ১ তারিখ থেকেই স্যার জিআই নিয়ে সিরিয়াস ভাবে প্রচার, চেষ্টা শুরু করেছিলেন। স্যারের গাইডেন্স আর তাঁর তৈরি আরিফা মডেলের মাধ্যমে দক্ষ হয়ে উঠা মানুষগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশের জিআই নিয়ে নিঃস্বার্থ ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে বলেই এতো দ্রুত আমরা ১১টা সম্ভাব্য জিআই পণ্যের ড্রাফট ডকুমেন্ট জমা দিতে পেরেছি, ইতিমধ্যে সেগুলোর বেশ কয়েকটার আবেদন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়ে গেছে, এটা অনেক বড় ব্যাপার, বিশাল সাফল্য আমাদের জন্য। 

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আর্টিকেলটি জিআই নিয়ে আমার ফেইসবুকে বিভিন্ন সময় লেখা পোস্টগুলোর সমন্বিত রূপ।

খাতুনে জান্নাত আশা
This is Khatun-A-Jannat Asha from Mymensingh, Bangladesh. I am entrepreneur and also a media activist. This is my personal blog website. I am an curious woman who always seek for new knowledge & love to spread it through the writing. That’s why I’ve started this blog. I’ll write here sharing about the knowledge I’ve gained in my life. And main focus of my writing is about E-commerce, Business, Education, Research, Literature, My country & its tradition.
https://khjasha.com

Leave a Reply

Top