খাবারের উদ্যোক্তাদের জন্য কাস্টমার ফিডব্যাক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাস্টমার কিন্তু তাদের মূল্যবান ফিডব্যাক তখনই দেয়, যখন তারা সন্তুষ্ট হয়, খুশি হয়। তবে ক্রেতারা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যস্ত থাকে, তাই ফিডব্যাক দেওয়ার কথা তাদের মনে নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে বিক্রেতার উচিত ক্রেতাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া, খাবার কেমন ছিল? কোনো সমস্যা ছিল কিনা? আরও কীভাবে ভালো করা যায় ইত্যাদি। তবে অবশ্যই বার বার এমন ভাবে প্রশ্ন করা যাবে না যে, ক্রেতা বিরক্ত হয়। তাকে সময় দিতে হবে। বিনয়ের সাথে বলতে হবে, ক্রেতা যেন ফ্রি হয়ে ফিডব্যাক দেন তার সময় মতো। একজন অনলাইন খাবারের উদ্যোক্তার জন্য ক্রেতার ফিডব্যাক কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা ক্রেতাকে বোঝাতে হবে সুন্দরভাবে।
উদ্যোক্তাদের করণীয় যা-
- ফার্স্ট ইম্প্রেশন ক্রিয়েট করতে ডেলিভারি চার্জ ফ্রি দেয়া সবচেয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত হবে। প্রথম ১০০ ডেলিভারি ফ্রি দেয়াই যথেষ্ট। এদিকে স্যার সব সময় খুব বেশিই জোর দেন। এটুকু লস করার মানসিকতা থাকতে হবে। ফলস্বরূপ ১০০ ডেলিভারিতে ১০০ কাস্টমারকে সন্তুষ্ট করা যাবে এবং ১০০ ফীডব্যাক পাওয়া সম্ভব হবে।
- খাবারের উদ্যোক্তারা একটা ব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দেন না বলে দেখেছি। সেটা হলো- খাবারের ম্যানু তৈরি। কী ধরণের খাবার উনার কাছে পাওয়া যাবে, কী কী আইটেম আছে, কোনো প্যাকেজ আছে কিনা, কোন খাবারের প্রাইস কতো ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর উত্তর একটা ম্যানুই দিয়ে দিতে পারে৷ আমার মনে হয় এটা ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ের জন্যই সহজ করে দেয়, খাবারের অর্ডার দেয়া নেয়ার ক্ষেত্রে। সুন্দর গুছানো একটা ম্যানু কিন্তু প্রফেশনালিজমও প্রকাশ করে। ক্রেতাদের সময় নেই কিন্তু এতো খুঁজে খুঁজে বের করার যে, কী কী সে সাধ্যমতো অর্ডার করতে পারে।
- ফুড ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও দেখেছি হোম মেইড ফুডের উদ্যোক্তারা খুব একটা নজর দেন না, সময় দেন না। অথচ একজন কাস্টমারকে আকর্ষন করতে খাবারের লোভনীয় ছবিই যথেষ্ট। অন্তত আমার ক্ষেত্রে দেখেছি, খাবারের সুন্দর ছবি দেখলেই জিভে জল এসে যায়, সেই খাবার খাওয়ার জন্য অস্থিরতা তৈরি হয়।
- তাই উদ্যোক্তাদের উচিত নিজেদের ম্যানু অনুযায়ী খাবারগুলো রান্না করে সুন্দর ফটোগ্রাফি করে রাখা। তারপর সব খাবারের ছবি একসাথে করে একটা ফুড এলবাম তৈরি করা। তারপর নিজের ফেইসবুক প্রোফাইলে প্রতিটি রান্নার বা খাবারের স্টোরিগুলো ক্যাপশন আকারে লিখে লিখে একটা ফুড এলবাম তৈরি করা। এটা ক্রেতা আকর্ষণ করতে এবং ক্রেতাদের কাছে নিজের প্রফেশনালিজম তুলে ধরতে অনেক বেশি ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয় আমার।
- ক্রেতারা চায় আন্তরিকতা। কাস্টমার আপনাকে খাবারের জন্য নক দেয়ার পর থেকে বাসায় খাবার পৌঁছে দেয়া এবং পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে খাবারের ফীডব্যাক জানা পর্যন্ত প্রত্যেকটা ধাপে আপনাকে আন্তরিক একটা পরিবেশ ক্রিয়েট করতে হবে, ধরে রাখতে হবে। ক্রেতার চাহিদা এবং ভালো লাগা খারাপ লাগা, কেমন খাবার তার পছন্দ অপছন্দ ইত্যাদি প্রশ্ন করে জেনে নেয়া উচিত খুব আন্তরিকতার সাথে।
- একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন মানুষের মনে জায়গা করে নেয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ভালো খাবার সার্ভ করতে পারা, খাবার খাইয়ে তাকে খুশি করতে পারা। এবং এটা দীর্ঘস্থায়ীও হয় বেশি। তাই অবশ্যই রান্নায় যতটা সম্ভব পারফেকশন ধরে রাখার উপর বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, যেন ক্রেতা সেই খাবারের স্বাদ মনে রাখতে বাধ্য হয়।
- ছোট্ট উপহার দেয়ার অভ্যাস করা। উপহার যত ছোটই হোক, সেটা মানুষের মনে খুব দাগ কাটে। খাবারের সাথে উপহার ব্যাপারটা আনএক্সপেক্টেড হবে, আর এটাই ক্রেতাকে অনেক বেশি টাচ করবে, ইমোশনাল করবে। যেমনঃ আমি সুমাইয়া আপুর কাছে আমার বোনের জন্য ওর জন্মদিনে খাবার অর্ডার করেছিলাম। আপু খাবারের সাথে এক্সট্রা আচার দিয়েছিল, যা আমার অর্ডারের বাইরে ছিল। ব্যাপারটা ভালো লেগেছিল আমার, এটাকে উপহার হিশেবেই বিবেচনা করেছিলাম আমি। আপু অবশ্য জন্মদিনের উপহার স্বরূপ চুড়িও পাঠিয়েছিলেন। এটা আরও টাচ করেছিল। এই যে বিশেষ দিনে বিশেষ ভাবে ট্রিট করতে পারা কাস্টমারকে এটাও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপুর এমন আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে কিন্তু আমি খুশি হয়েই ফীডব্যাক জানিয়েছি আপুকে, রিভিউও দিয়েছি।
- কাস্টমার ফীডব্যাক নিয়ে স্টোরি তৈরি করা যায়। খাবারের উদ্যোক্তারা কিন্তু তাদের কাস্টমারদের দেয়া ফীডব্যাক নিয়ে খুব সহজেই গল্প তৈরি করতে পারেন, ক্রেতাদের সম্মানিত করতে পারেন। কাস্টমার ফীডব্যাক স্টোরি নিয়েও একটা এলবাম নিজের ফেইসবুক প্রোফাইলে করতে পারেন। এ ধরণের এলবাম করার জন্য খুব ভালো উপায় হলো- সেই ক্রেতার একটা ছবি, তার অর্ডারকৃত খাবারের সুন্দর ছবি এবং তার দেয়া ফীডব্যাক… এই তিনটা জিনিস একসাথে করে একটা ছবি তৈরি করা Thumbnail ক্রিয়েট করার মতো করে। দেলোয়ার ভাইকে দেখেছি এমন করে কাস্টমার ফীডব্যাক শেয়ার করতে।
এমন ছবির সাথে কাস্টমারকে নিয়ে লেখা গল্প সহ কাস্টমার ফীডব্যাক স্টোরি এলবামে আপলোড করা। এভাবে যদি ১০০ টা ফীডব্যাক স্টোরি করা যায় ধারাবাহিক ভাবে, তাহলে মনে হয় না সেই খাবারের উদ্যোক্তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
- বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ খাবার আইটেম তৈরি করা। হোমমেইড খাবারের দাম বেশি অভিযোগ শোনা যায় প্রায়ই। তবে হোমমেইড ফুড হাইজেনিক, পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যের জন্য ভালো, চাহিদা এবং পছন্দ মতো কাস্টমাইজ করে নেয়া যায় ইত্যাদি অনেক পজিটিভ দিক এর রয়েছে, তাই প্রাইস আল্টিমেটলি ম্যাটারই করে না। আর মানুষ বিশেষ করে বাচ্চাদেরকে ভালো খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে কখনো দামের দিকটা চিন্তাই করে না৷ তাই এদিকে উদ্যোক্তারা ফোকাস করে নিজেদের খাবারের প্রচার করতে পারে।
- যেমন ধরেন বাচ্চারা ন্যুডলস পছন্দ করে, সস পছন্দ করে, চকলেট, কুকিজ, সসেজ, চিকেন নাগেটস ইত্যাদি পছন্দ করে। এগুলো আইটেম যদি হোমমেইড উদ্যোক্তাদের কাছে পাওয়া যায়। তাহলে বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াতে হবে না বাচ্চাদেরকে। এটা একটা ইমোশনাল মার্কেটিং স্ট্রাটেজি হতে পারে খাবারের উদ্যোক্তাদের জন্য। আমার হোমমেইড মাখন, ঘি স্বাস্থ্য সচেতন যারা, সবাই খুঁজে। এগুলোকে তাই কাঙ্ক্ষিত কাস্টমারদের সামনে নিয়ে আসার জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্যকর মেসেজটাকে ফোকাস করে লিখে যেতে হবে।
- আরেকটা কাজ করা যায় যা কর্মজীবী মায়েদেরকে অনেকাংশে চিন্তামুক্ত করবে, তা হলো- স্কুল গোয়িং বাচ্চাদের জন্য টিফিন আইটেমের ব্যবস্থা করা। হোমমেইড খাবারের উদ্যোক্তাদের জন্য এটা খুব ভালো একটা সুযোগ তৈরি করতে পারে। কারণ ঢাকায় যারা আছেন তারা জানেন যে- যে সব নারীরা জব করে তাদেরকে অনেক সকালে বের হয়ে যেতে হয়, বাচ্চাদের টিফিন রেডি করে দেয়া তাদের জন্য বেশ কঠিন একটা কাজ। ফলে বেশির ভাগ বাচ্চারা প্রতিদিন বাইরের খাবার খায় বাধ্য হয়েই, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই খাবারের উদ্যোক্তারা এই গ্যাপটা ফিল করতে পারেন চাইলেই৷
তবে এক্ষেত্রে ডেলিভারি একটা বড় সমস্যা। তবে যদি ফ্রোজেন আইটেমের দিকে ফোকাস করা যায়, তবে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে অনেকটাই।
- সিজনাল খাবার যেমন, শীতকালীন পিঠা ক্রেতা আকর্ষন করতে পারবে খুব সহজেই। পিঠা বানানো বেশ সময় সাপেক্ষ কাজ, ধৈর্যের কাজ। বর্তমানে খুব কম নারীরাই বাসায় পিঠা বানানোর সময় পায়, তবে খেতে চায় কিন্তু সবাই। তাই পিঠাকেন্দ্রিক বিশাল বাজার রয়েছে আমাদের, যা এখনো উদ্যোক্তারা ধরতে পারছে না। খুব ভালো হয় শুকনো কিছু পিঠার আইটেম উদ্যোক্তারা তৈরি করতে পারলে, যা সারাদেশেই ডেলিভারি দেয়া সম্ভব হবে। এমন হলে অনেক ক্রেতা ক্যাপচার করা সম্ভব হবে।
- খাবারের উদ্যোক্তাদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো খাবার প্যাকেজিং এর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নজর দেয়া। কারণ ডেলিভারি দিতে গিয়ে খাবার নষ্ট করে এমন অনেক রেকর্ড আছে। খাবার যেন এলোমেলো না হয়, তেল ঝোল মসলা যেন সব বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ না পায় ইত্যাদি ব্যাপারে খুব সতর্কতা প্রয়োজন, সর্বোচ্চ ভালো প্যাকেজিং করতে হবে। ডেলিভারি বয়কেও সাবধানে ডেলিভারি দেয়ার জন্য বলে দিতে হবে।
- ক্রেতাদের থেকে শর্ট ভিডিও ফীডব্যাক নেয়া যায়। জুথি আপু এমন কিছু ভিডিও ফীডব্যাক আপলোড করেছেন দেখেছি উনার রাজবাড়ির চমচমের ক্রেতাদের। খুব ভালো লেগেছে দেখে। এমন ১০০ ভিডিও একসাথে করা গেলে বিশাল সম্পদ হবে একজন উদ্যোক্তার জন্য।
- ক্রেতাদের নিয়ে অনলাইন আড্ডা। দেলোয়ার ভাই কিছুদিন উনার ক্রেতাদেরকে নিয়ে লাইভ আড্ডার আয়োজন করতেন। ব্যাপারটা ভালোই লাগত। তবে এভাবে আলাদা আলাদা ক্রেতাদের নিয়ে লাইভ করা যেতে পারে আবার সব ক্রেতাদের নিয়েও একটা জুম আড্ডার আয়োজন করা যেতে পারে। যেখানে ক্রেতারা মন খুলে তাদের ফীডব্যাক শেয়ার করবে, কোনো প্রশ্ন থাকলে করবে, আবার তাদের বিশেষ কোনো খাবার ম্যানুতে এড করার সাজেশন থাকলে দিবে ইত্যাদি অনেক বিষয় এমন লাইভ আড্ডায় উঠে আসতে পারবে।
ইনবক্সে ক্রেতাদেরকে লিঙ্ক পাঠিয়ে ফর্ম ফিল আপ করার আহবান করা যেতে পারে, তখন যারা ইচ্ছুক সেই সব ক্রেতাদের নিয়েই আড্ডা হতে পারে।
- একটা সিগনেচার রেসিপি তৈরি করা অথবা যে কোনো একটা খাবারকে কেন্দ্র করে প্রথমে মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া। আসলে প্রত্যেকেরই নিজস্বতা থাকা উচিত। একজন উদ্যোক্তা থেকে আলাদা করে আরেকজনকে তখনই আমরা চিনব যখন সে একটা নির্দিষ্ট খাবারকে ফোকাস করবে। সেই খাবারের নামটার সাথে তখন সবার মনে তার নামটাও গেঁথে যাবে। রাজিব আহমেদ স্যার সব সময়ই যে কোনো একটা প্রোডাক্টের উপর ফোকাস করতে বলেন সব উদ্যোক্তাদেরকেই। পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং এর জন্য এটা খুবই কার্যকরী একটা স্ট্র্যাটেজি।
ধরেন, আপনি কোনো একটা পিঠা ভালো বানাতে পারেন। আপনার উচিত তাহলে সারা বছর ধরে সেই পিঠা নিয়ে লিখে যাওয়া। প্রতিদিন অন্তত একটা পোস্ট লিখলেও যথেষ্ট। এটা করতে পারলে এমন হবে যে, শীতকালে পিঠার মৌসুম আসতে আসতে আপনি এতোটাই পরিচিত হবেন পিঠা ওয়েভ হলে সবার আগে আপনার কথাই প্রথমে প্রত্যেকের মাথায় আসবে। প্রতিযোগিতার যুগে নিজের এই ইউনিক আইডেন্টিটি তৈরি করা খুব জরুরী।
- রান্নাঘরের ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি তৈরি করতে পারেন শর্ট ভিডিও আকারে। ক্রেতারা হোমমেইড ফুড বেশি দাম দিয়ে কিনে খায় দুইটা কারণে। এক হলো- নিজের সময় আর কষ্ট বাঁচাতে, আরেক হলো- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ভেজালমুক্ত খাবার খেতে। তাই আপনি কতোটা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না করেন, কীভাবে হাইজিন মেইনটেইন করেন এগুলো ভিডিও করে ক্রেতাদের সামনে প্রেজেন্ট করতে পারেন। এটা ক্রেতাদের আস্থা বিশ্বাস বৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করবে এবং নিশ্চিন্তে তারা খাবার অর্ডার করতে পারবে।
- অনেক ক্রেতা আছেন সুন্দর করে রিভিউ দিতে চান, কিন্তু বাংলা টাইপ করতে সমস্যা হয় তাদের বা গুছিয়ে লিখতে পারেন না হয়ত ঠিক ভাবে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা ইনবক্সে ক্রেতার থেকে ফিডব্যাক নিয়ে নিজেই গুছিয়ে একটা রিভিউ পোস্ট লিখে ক্রেতাকে দিতে পারেন তার প্রোফাইলে বা কোনো খাবারের গ্রুপে আপলোড করার জন্য।
লেখকঃ
রিসার্চার, দেশি পণ্য ই-কমার্স