বাংলাদেশের প্রথম সৌদি খেজুর চাষী-ভালুকার মোতালেবের গল্প আরিফা মডেল ময়মনসিংহ ময়মনসিংহ বিভাগ মোটিভেশনাল by খাতুনে জান্নাত আশা - August 11, 2021August 11, 20210 Spread the lovemoreআমি এটা সব সময় বিশ্বাস করি যে, স্রোতের বিপরীতে চলার জন্য, চ্যালেঞ্জিং কিছু করার জন্য পাগল হতে হয়। হ্যাঁ, এই পাগলামি নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পাগলামি। একান্ত নিজের উপর আত্মবিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় এই পাগলামি। তবে তখন- “আমি পারবই” শুধু এই প্রেরণা নিয়েই আকাশ ছোঁয়া সম্ভব হয়। প্রত্যেকের প্রশ্ন করতে হবে নিজেকে, নিজের স্বপ্ন ছোঁয়ার জন্য আমি ঠিক কতটা পাগল হতে পারব! সব ছেড়ে গেলেও আমি আমায় ছাড়ব না এই আত্মবিশ্বাস ধারণ করতে হবে নিজের মাঝে। ঠিক এমনই এক পাগলামি থেকে আকাশ ছোঁয়ার গল্প শুনব আমরা, যা আপনাকে অনুপ্রাণিত করবেই। সবার কাছে যে পাগল বলে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল, সেই আজ সারাদেশের আইডল হয়ে গেছে! বলছিলাম ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার পাড়াগাঁও এর আবদুল মোত্তালেবের কথা। তিনিই প্রথম এদেশে বিখ্যাত আরব্য খেঁজুরের বানিজ্যিক চাষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন শুধুমাত্র নিজের উপর আস্থা আর আত্মবিশ্বাস থাকার কারণে। এ এক অসম্ভব কে সম্ভব করার গল্প! দরিদ্র পরিবারের ছেলে আবদুল মোতালেব ১৯৯৮ সালে সৌদি আরব গিয়েছিলেন কাজের খোঁজে। তিনি শুধু কৃষি কাজ জানতেন, তাই মনে মনে চাইতেন বিদেশ গিয়ে যেন কৃষি কাজ করার সুযোগটাই পান। সৃষ্টিকর্তা তার আরজি শুনেছিলেন, তাই সৌভাগ্যক্রমে মোতালেব কাজ পেয়ে যান পবিত্র মরুর দেশের এক আজুয়া খেঁজুর বাগানে। গাছ থেকে যখন খেঁজুর পারা হয়, তখন বাগানে উপস্থিত সবাই সাধারণত খেঁজুর খায়। মোতালেবও একদিন সেই বিখ্যাত আজুয়া খেঁজুর খান। মুখে পুরার সাথে সাথেই তিনি অনুভব করেন, এই খেঁজুর তার দেশে নেয়া চাই! তিনি ভাবেন, দেশে আরবের এই পবিত্র আজুয়া খেঁজুর তিনি চাষ করতে পারলে বিরাট এক সাফল্যের গল্প তৈরী হবে, সারাদেশ থেকে তার কাছে আসবে মানুষ এই খেঁজুর গাছ দেখার জন্য, খেঁজুর নেয়ার জন্য। আর তাকেও বিদেশে আসতে হবে না, দেশে থেকে খেঁজুর চাষ করে জীবন জীবিকা খুব ভালো ভাবেই চালাতে পারবে। মনে মনে সিদ্ধান্তটা তখনই নিয়ে নেন, যে করেই হোক এই খেঁজুর বাংলাদেশে চাষ করবেন তিনি। ২০০১ সালে ছুটি নিয়ে দেশে আসার সময় সেই খেজুর বাগানের মালিকের কাছে বলেন- “মালিক, অনেক দিন তো আপনার এখানে কাজ করেছি। আমাকে কিছু খেজুরের বীজ দেন।” তখন সেই বাগানের মালিক তাকে বললেন- “বীজ দিব, তবে তোমার ৬ মাসের বেতন কেটে নেয়া হবে।” মোতালেব সেই শর্ত মেনে, ৬মাসের ৩৬০০ রিয়াল বেতন ছেড়ে দিয়ে দেশে খেজুরের বীজ নিয়ে ফিরে এলেন!! (আমি ভাবছিলাম, কি চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত!!) দেশে ফিরে আসার পর শুরু হল তার আসল পরীক্ষা। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন এসেই, আর ফিরে যাবেন না! দেশেই খেজুর বাগান করে জীবিকা নির্বাহ করবেন। খেজুরের বীজ এদেশের মাটিতে কিভাবে বুনলে সেই আরব্য খেজুরের মতোই হবে, তা নিয়ে চলল তার দিন রাত গবেষণা! পাড়া, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব সবাই প্রথমে হাসাহাসি করতে থাকে যে, জীবনে এমন শুনেনি কেউ যে আরবের খেজুর এদেশে জন্মানো সম্ভব! বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। প্রথমে সবাই বলল, বীজ থেকে চারা জন্মানোই সম্ভব না৷ তারপর বলে, চারা হলেও কখনো খেজুর ধরবে না। কেউ বলে, খেজুর হলেও সেরকম হবে না, গাছে থাকবে না, ঝরে পরবে!! এক সময় মোতালেব কে পাগল বলে সম্বোধন করতে শুরু করল এলাকাবাসী। এমনকি তার স্ত্রীও তার উপর আস্থা রাখতে না পেরে, খেজুরের বীজ নিয়ে পাগলামি সহ্য করতে না পেরে, মোতালেব কে ছেড়ে বাচ্চাদের নিয়ে পাড়ি জমালো বাবার বাড়ি। কিছুতেই নিজের স্বপ্ন থেকে একবিন্দু সরলেন না মোতালেব। একাকীই লড়ে গেলেন। তার প্রতিজ্ঞা একটাই- হাদিসে বর্ণিত, মহানবী (সঃ) এর মোজেযা এবং সর্বাধিক পছন্দের আজুয়া খেঁজুর এদেশের মাটিতে তিনি ফলিয়ে দেখাবেন। সৃষ্টিকর্তা চাইলে এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। এভাবে দীর্ঘ আত্মত্যাগ আর একাকী অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এক সময় খেজুরের বীজ থেকে সবাইকে বিস্মিত করে গাছ উঁকি দিতে শুরু করল। তখন শুরু হল নতুন অত্যাচার! পেছনে লেগে গেল শত্রু! রাতের অন্ধকারে কখনো উপ্রে ফেলতে শুরু করল চারা গাছ, কখনো বাগানে পানি দেয়ার মেশিনটাই চুরি করে নিয়ে গেল! এভাবে বাগানের ক্ষতি করার জন্য মানুষ উঠে পরে লাগল যেন! তখন মোতালেব বাগানেই একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর তৈরী করলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি এখানেই থাকবেন। আর গাছে খেজুর না ধরা অব্দি তিনি ভাত খাবেন না! তাকে পাগল ভাবার পরিধি তখন আরও বাড়ল। তাকে নিয়ে তখন শুধু হাসি ঠাট্টা চলত এলাকায়। তিনি এসবের পরোয়া করতেন না, কারো কোনো কথার প্রতিবাদ করতেন না। শুধু একমনে কাজ করে যেতেন আর অপেক্ষা করতেন কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের জন্য। এভাবে দীর্ঘ ৬ বছর লেগে থাকার পর সবাইকে আবার বিস্মিত করে গাছে বিখ্যাত আজুয়া খেজুর ধরতে শুরু করল! এবার মোতালেবের চ্যালেঞ্জিং জীবনের সমাপ্তি ঘটতে শুরু করল ধীরে ধীরে আর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল তার এই সাফল্যের গল্প। বাগান বড় হল, আজুয়া খেজুর ছাড়াও আর কয়েক জাতের আরব্য খেজুরের গাছও জন্মাল। চারদিক থেকে মানুষের ভীড় জমতে শুরু করল মোতালেবের বিস্ময়কর এই সৃষ্টি দেখার জন্য। পরিবার, সমাজ, বন্ধু -বান্ধব, আত্মীয়- স্বজন সবাই আবারও ফিরে এলো আগের মতো করে! মোতালেবের ছনের ঘর থেকে এখন তৈরী হয়েছে ইটের দালান। তার গাছ থেকে খেজুর তো নয়, সোনা ফলে যেন। খেঁজুর গাছে থাকা অবস্থায়ই মানুষ বুকিং দিয়ে যায় এসে। এক কেজি আজুয়া খেজুর ৩ হাজার টাকা পর্যন্তও দাম হয়। আর একেকটা খেজুর চারা গাছের দাম হয়, ২০০ থেকে ৫লাখ টাকা পর্যন্ত!!!! মোতালেবের সৌদি খেজুর বাগান এক মিরাকলের নাম! মোতালেবের থেকে খেজুর বীজ আর চারা নিয়ে এখন সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখছে এখন আরব্য খেজুরের চাষ নিজে করার। যে গল্পটা বললাম এতোক্ষন, এটা ২০০১-২০২১ পর্যন্ত ২০ বছরের ফলো আপ গল্প। এটা শুন্য থেকে সেরা হওয়ার অন্যতম প্রধান উদাহরণ!! দেশে এই সময়ে অনেক নতুন খেজুর চাষী যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু আরব্য খেজুর এদেশে মোতালেবের সৌদি খেজুর বলেই পরিচিতি পাবে আজীবন। ভীষণ ভাবেই ফিল করছিলাম এই বাস্তব জীবনগাঁথা! আমার মনে এটা বিশেষ অনুপ্রেরণার বীজ বুনে দিল। স্বপ্নপূরণে এমন পাগল হতে না পারলে হয়ত স্বপ্নগুলো সব অধরাই থেকে যাবে! আমরা কি পারব এমন পাগল হতে?????? Like this:Like Loading... Related Spread the lovemoremore