You are here
Home > বুক সামারি & রিভিউ > দত্তা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (উপন্যাস রিভিউ)

দত্তা – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (উপন্যাস রিভিউ)

দত্তা
Spread the love

দত্তাশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

(উপন্যাস রিভিউ)

 

 

“দত্তা” শরৎচন্দ্রের কালজয়ী রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে আজও একিরূপ সমাদৃত প্রকাশের ১০৩ বছর পরেও। বাংলার এই জনপ্রিয় লেখক তাঁর লেখণীতে সব সময়ই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের অসামঞ্জস্যতা, দারিদ্র, অবহেলিত নারীদের দু;খগাথাসহ বিভিন্ন সামাজিক ক্ষতগুলোর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। “দত্তা” রোমান্টিক উপন্যাস হলেও তাই এটি অন্তঃর্নিহিত অনেক তাৎপর্যই বহন করে, যা গভীরভাবে উপলব্ধির বিষয়। বিশিষ্ট জনেরা এর মূল্ভাব বহুভাবে ব্যাখ্যা করে এসেছেন বহু বছর ধরে, আজ আমি চেষ্টা করছি আমার নিজস্ব চিন্তার গভীরতা দিয়ে একে বিশ্লেষন করার উপন্যাসের দৃশ্যপটগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরার পাশাপাশি।

 

মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে পারিপার্শ্বিকতার  পাশাপাশি তাদের চিন্তাভাবনা এবং স্বপ্নের মাঝে আমূল পরিবর্তন ঘটতে থাকে৷ কখন কার জীবন কিরূপে পরিবর্তিত বা আবর্তিত হবে, কখন কোন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে হবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা প্রায় অসম্ভব। এই উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে ঠিক এই ম্যাসেজটা দিয়েই এবং এর মিল বাস্তব জীবনের সাথে প্রতি মুহূর্তেই লক্ষ্যনীয় বলে দেখে এসেছি।

 

স্কুল পড়ুয়া তিন বন্ধু বনমালীবাবু, রাসবিহারী আর জগদীশ ছিল অন্তঃপ্রান। তাদের ধারণা ছিল কোনোদিন তাদেরকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। তাই একদিন বটবৃক্ষকে সাক্ষী মেনে প্রতিজ্ঞা করেছিল-

 

তারা কেউ বিয়ে করবে না, অনেক অর্থ উপার্জন করবে এবং তাদের সম্মিলিত উপার্জন একসাথে জমিয়ে সামাজিক কাজে ব্যয় করবে।

 

কিন্তু বড় হয়ে এক সময় তারা এ প্রতিজ্ঞা ঠিক ভুলে গেল। বনমালীবাবু, রাসবিহারী ব্রাক্ষ্মধর্মে দীক্ষা নিয়ে বিয়ে করে কলকাতা পাড়ি জমাল আর জগদীশ তার হিন্দু ধর্ম আঁকড়ে ধরে সেই পাড়া গায়েই পরে রইল, হত দরিদ্র জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ চলতে লাগল। অথচ এই জগদীশই তিন বন্ধুর মাঝে সবচেয়ে সেরা ছাত্র ছিল, তাই তাকে নিয়ে আশা ভরসা বেশি ছিল সবার যে, এক সময় বন্ধুটি অনেক ভালো কিছু করবে।

 

বনমালীবাবুই ছিলেন তাদের মাঝে সবচেয়ে প্রতাপশালী, গ্রামের জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী হিসেবে বিশাল জমিদারি ছিল তার, কিন্তু ব্রাক্ষ্মধর্ম গ্রহণ করায়ই গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল তাকে জমিদারি রেখেই। তখন থেকেই তার জমিদারির সব দেখাশোনা করত আরেক বন্ধু রাসবিহারী, পরে সেই দায়িত্ব্য পালনে যোগ দিয়েছিল রাসবিহারীর ছেলে বিলাসবিহারী। তারা এক সময় দেখাশোনা করতে করতে বনমালীবাবুর জমিদারিতে অনেকটা নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল।

 

তবে তিন বন্ধুর মাঝে বনমালীবাবু জগদীশকে চিরদিন একটু বেশিই ভালবাসত, কারণ মনের দিক থেকে যে জগদীশ সবচেয়ে উন্নত ছিল এটা স্পষ্টতই বোঝা যেত। দূরত্ব বাড়লেও, ধর্ম আলাদা হলেও তাদের মাঝে নিয়মিত তাই যোগাযোগ ছিলই। জগদীশের ছেলে নরেন্দ্রনাথ যেদিন জন্মাল, সেদিন জগদীশ বন্ধু বনমালীকে চিঠি লিখেছিল যে, বনমালীর মেয়ে হলে তার ছেলের বউ করতে চায় সে। বনমালী বন্ধুর এ প্রস্তাবে সেদিন হেসেছিল, আর মনে মনে হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়েই ছিল মেয়ে হলে তাকে জগদীশের ছেলের কাছে পাত্রস্ত্ব করার জন্য।

 

বনমালীর মেয়ে বিজয়ার জন্ম হল, জন্মের পরই মা মারা গেল তার।

 

আর এদিকে প্রিয় বন্ধুর আবদার রক্ষায়, পরবর্তীতে বনমালী জগদীশের ছেলেকে না দেখেও দূর থেকে  নিজের মেয়ের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল, তাকে নিজের খরচে বিলেতে ডাক্তারি পড়তে পাঠিয়েছিল। আর বিজয়াকেও সে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে একজন বিদুষী নারী হিসেবেই গড়ে তুলেছিল। হিন্দু সমাজে নারীশিক্ষাকে তখন অপরাধ মনে হলেও ব্রাক্ষ্মসমাজের মেয়েরা অনেক স্বাধীনচেতা ছিল, তাদের শিক্ষা অর্জনে কোনো বাঁধা ছিল না।

 

হঠাৎ অসুস্থতায় বনমালীবাবুর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে মেয়েকে ডেকে সে যে কথাগুলো বলেছিল, সেই কথাগুলোতে মেয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস, ভালোবাসা প্রকাশের পাশাপাশি সুশিক্ষিত মেয়ের জ্ঞানের প্রতি অনেক বেশিই ভরসা প্রকাশ পেয়েছিল। বনমালীর বিশাল জমিদারীর একমাত্র উত্তরাধিকারী তাঁর মেয়ে, কিন্তু এই মেয়ে যে কোনো ছেলের থেকেও অনেকখানি এগিয়ে, তার উপর যে নির্দ্বিধায় সব ভার অর্পণ করে নিশ্চিন্তে চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়া যায় তাই সে বুঝিয়েছিল। তবে সেদিন জগদীশ এবং তাঁর ছেলে নরেন সম্পর্কিত যে ইঙ্গিত মেয়েকে সে দিয়েছিল, যে আকাঙ্ক্ষা পরোক্ষরূপে প্রকাশ করেছিল, সেগুলো বিজয়ার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে নি হয়ত কোনো এক কারণে, তাই সে নরেনের গুরুত্বটাও তখন বোঝে নি এতোটা।

 

হতদরিদ্র জগদীশ তাঁর জমি বাড়ি বন্ধক রেখে বনমালীর থেকে টাকা ধার নিয়েছিল, যা পরবর্তীতে শোধ করে দেয়ার মত অবস্থা তাঁর ছিল না। এই সুযোগে বনমালীর মৃত্যুর পর তাঁর জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্বে থাকার সুযোগে রাসবিহারী আর তাঁর ছেলে বিলাসবিহারী জগদীশের বন্ধকী বসত বাড়ি আর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। নিঃসম্বল পাগল পাগল অবস্থায় নেশাগ্রস্ত জগদীশ বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পরে আত্মহত্যা করে। বিলাসবিহারী তখন বিজয়াকে তাঁর বাবার জমিদারি সম্পর্কিত তথ্যসহ যা তথ্য দিত সবই তাদের নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করে, দূর থেকে বিজয়াকে যা বোঝাত তাই বুঝত সে। জগদীশ আর নরেন সম্পর্কে একটা ভালো কথাও তখন বিজয়ার কানে পৌঁছুত না, যত বাজে ভাবে তাদেরকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা যায়, সবটুকুই করত বিলাসবিহারী। বিজয়াকে সে বোঝাল যে, জগদীশের বাড়ি বাজেয়াপ্ত করে সেখানে ব্রাক্ষ্মমন্দির প্রতিষ্ঠা করে ব্রাক্ষ্মসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করবে তারা। বিজয়া তখন এই প্রস্তাবের গভীরতা তলিয়ে না দেখে সম্মতি দিয়ে দিল, যদিও তাঁর মনে জগদীশ এবং নরেনের সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন আর কৌতূহল ছিল, কিন্তু সেগুলো মেটানোর সুযোগ ছিল না।

 

এই ব্রাক্ষ্মমন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য, সব কার্যক্রম দেখার জন্য বিলাস বিজয়াকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব করল। বিজয়া কখনোই নিজ গ্রামে না গেলেও পুর্বে বাবার কাছে শোনা স্মৃতি তাকে টানতে লাগল সেখানে যাওয়ার জন্য। বিলাসও তাদের গ্রামের বাড়ি অল্প কিছুদিনের  মাঝেই বিজয়ার থাকার উপযোগী করে ফেলল, নিজ গ্রাম আর জমিদারীতে প্রথম পদার্পন করল বিজয়া। আর সেখান থেকেই নতুন গল্প, নতুন জীবন শুরু হল তার।

 

বিজয়ার আগমন কিন্তু গ্রামবাসীকে খুব একটা খুশি করতে পারেনি। জমিদারদার পরিবারকে তারা যেন অনেকটা উপদ্রবের মতোই দেখত, কারণ ইতিমধ্যেই ম্যানেজার রাসবিহারীর অত্যাচারেই অতিষ্ঠ ছিল তারা। আর বিজয়া যাওয়ার সাথে সাথেই রাসবিহারী আর বিলাস গ্রামের একমাত্র দূর্গাপূজোর উৎসবও বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে দিল, যা গ্রামবাসীকে আরও অসহায় করে দিল।

 

জগদীশের একমাত্র ছেলে নরেন তখন বিলাত থেকে ডাক্তারি পাশ করে ফিরে এসেছিল গ্রামে। সে তার মামা বাড়িতে ছিল, আর সেখানেই গ্রামের একমাত্র দুর্গাপূজার আয়োজন হত। গ্রামের নিঃস্বপ্রায় মানুষগুলো আনন্দ বলতে এই পূজোই আসে বছরে একবার। আর এও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুনে নরেন আর স্থির থাকতে না পেরে নিজেই গিয়ে হাজির হল জমিদার বাড়িতে, বিজয়া নরেনের এই প্রথম দর্শনক্ষন ছিল এটাই!!

 

প্রথম দর্শনেই বিজয়া যদিও বুঝেছিল এই মানুষটার বিশেষত্ব, তবে তখনও সে জানত না এই যে সেই নরেন, যাকে ঘিরে তার অগাধ কৌতূহল! তারপরও এই মানুষটার ব্যক্তিত্ব তাকে দূর্গাপূজো নিয়ে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করেছিল, রাসবিহারী আর বিলাসের অসন্তুষের পরও বিজয়া পূজোর অনুমতি দিয়েছিল।

 

এরপর বিজয়া নরেনের দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে নদীর ধারে, সেদিনও নরেন তার পরিচয় গোপন করে এবং নরেনের বন্ধুর পরিচয়ে বিজয়ার সাথে নরেনের বর্তমান অবস্থার বিবরণ দিয়ে বিজয়ার কৌতুহল মিটিয়ে যায়। বিজয়া নরেনের সাক্ষাৎ প্রত্যাশী ছিল এবং চেয়েছিল তাদের বাড়ি বাজেয়াপ্ত করা ঠেকানোর আবদার নিয়ে যেন নরেন তার কাছে আসে। কাউকে আশ্র‍য়হীন করার ইচ্ছে কখনোই ছিল না বিজয়ার, যা করছিল সে সবই পরিস্থিতির চাপে পরে রাসবিহারী আর বিলাসের কথা রাখতে গিয়ে।

 

কিন্তু নরেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এক সুপুরুষ, সে না খেয়ে থাকবে, ঘরহীন হয়ে পথে পথে ঘুরবে, কিন্তু কারো থেকে সহানুভূতি প্রত্যাশা করে নিজেকে ছোট করে রাখবে না, এমনটাই ছিল সে। বিজয়া নরেনকে চিনতে না পেরেও তার সব কথা মুগ্ধতা নিয়ে শুনত, হৃদয় গহীন থেকে মানুষটার প্রতি একটা তীব্র টান অনুভব করত। কথা বলতে বলতে অনেক কথাই তাদের মাঝে হয়েছিল, নরেনের কথা বিজয়া যত বেশি জানছিল, তাকে গৃহহীন করাটা তার জন্য ততটাই লজ্জাজনক লাগছিল!

 

বিজয়া জানতে পারল যে,

 

নরেন বিলেতি ডাক্তার হয়েও সে ডাক্তারি প্র‍্যাক্টিস করে না এখানে। বিলেতি ডাক্তারের সেই যুগে অসম্ভব ডিমান্ড ছিল, তাদের টাকার অভাব অন্তত হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু নরেন সেই সুযোগ না নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য, হত- দরিদ্র কৃষকদের জন্য কাজ করছিল।

 

তার বাবার ভিটেটা তার নিজের থাকার জন্য দরকার ছিল না, কিন্তু তার একটা পাঠশালা সে এখানে গড়ে তুলেছিল যেখানে গ্রামের ছোট থেকে বৃদ্ধ সবাই পড়তে আসত, শিখতে আসত। মূলত নরেন কাজ করছিল গ্রামের কৃষকদেরকে শিক্ষিত করতে, প্রকৃতি নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে, আকাশের বৃষ্টির অপেক্ষায় দিন না গুনে, কি করে নিজেরা কৃষি পদ্ধতি শিখে সারাবছর ফসল ফলাতে পারবে সেই পদ্ধতিই হাতে কলমে শেখাত সে। তাঁর একটা মাইক্রোস্কোপ ছিল, যা দিয়ে সে বিভিন্ন কিছু গবেষণা করত। সর্বোপরি, তাঁর কাজ আর চিন্তার জগতটাই আলাদা ছিল, যা দিয়ে সব সময় সে সমাজ এবং এর মানুষগুলোর জীবনে পজিটিভ পরিবর্তন আনার কথা ভাবত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর সৎ উদ্দেশ্যে বাঁধা হয়ে এসেছিল তাঁর বাবার ঋনের বোঝা।

 

** উপন্যাসের এই পার্ট্টুকুই আমাকে বিশেষ আকর্ষন করেছে এইবার। আগেও এটা পড়েছি, কিন্তু এই দৃশ্যপটের তাৎপর্য এভাবে মনে জায়াগা করে নিতে পারেনি। তবে এইবার এটুকু পড়ে থেমেছি এবং কম হলেই ৫-৬ বার পড়েছি শুধু এই অংশটুকুই। নরেনকে বোঝার চেষ্টা করেছি, ১০০ বছরের বেশি সময় পূর্বে লেখা এই উপন্যাসের নরেন চরিত্রের মাধ্যমে লেখক সমাজ পরিবর্তনের যে মেসেজটা দিয়েছিলেন সেটা অনুধাবন করেছে ক’জন এবং এমন চরিত্রে নিজেকে ভেবে সেই অনুযায়ী কাজ করতে চেয়েছে ক’জন!! আসলে সব সময় এমন পজিটিভ এবং স্পেশাল জিনিসগুলোই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কিন্তু কিছু মানুষ ঠিকই এগুলো বুঝে নেয় এবং নিজের মাঝে সেই গুনের বিকাশ ঘটায়, আর এ ধরনের মানুষগুলোই যুগ যুগ ধরে সমাজ সংস্কারে অবদান রেখে চলেছে নিঃস্বার্থভাবে।

যেমনঃ আমাদের স্যারের বিচক্ষন দৃষ্টি কিন্তু এই দৃশ্যপটের গুরুত্ব ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিল বহু বছর পূর্বেই এবং একে নিজের মাঝে ধারন করেছিল। আর তাই বছরের পর বছর ধরে স্যারের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এতো কিছু পরিবর্তিত হচ্ছে প্রতিদিন, যার রেজাল্ট আমরা পাচ্ছি।

 

আবারও ফিরে আসি বিজয়া-নরেনের গল্পে।

 

বিজয়া আর নরেনের ধীরে ধীরে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে হলেও বিজয়া নরেনের আসল পরিচয় পায় একদিন। রাসবিহারী আর বিলাস বিজয়ার মন বিভিন্নভাবে বিষিয়ে দিতে থাকে, নরেন বিজয়ার সুসম্পর্কে তারা খুশি হতে পারে না। কারণ রাসবিহারী চেয়েছিল খুব দ্রুত তাঁর ছেলে বিলাস বিজয়াকে বিয়ে করবে আর সব জমিদারি করায়ত্ত্ব করবে। নরেন যেন তাঁর প্ল্যানিং এ বড় উপদ্রবের মতোই এসেছিল, তাই বিনা কারণে বিভিন্নভাবে বাবা ছেলে মিলে নরেনকে অপমান অপদস্ত করতে লাগল। নরেন বিজয়া-বিলাসের সম্ভাব্য বিয়ের ব্যাপারটা জানত না বলেই এতো অপমানের হেতু খুঁজে না পেয়ে বিস্মিত হত বার বার।

 

এদিকে বিজয়া নরেনের প্রতি বড্ড বেশিই অনুরক্ত হয়ে পরে, এই মানুষটাকে গৃহহীন করার জন্য অপরাধবোধে পিড়ীত হয় খুব। তাই প্রতি মুহূর্তে ভেবে যায়, কি করে নরেন কে সে সাহায্য করতে পারবে। সুযোগ মিলেও যায়। নরেন তাঁর শেষ সম্বল মাইক্রোস্কোপ বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে কলকাতা অব্দি যেয়ে কোনো রকমে একটা চাকরি আর মাথা গোজার ঠাই করে নিতে চাইছিল। বিজয়া এই জিনিসের কোনো ব্যবহার না জানা স্তত্বেও নরেনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে সেটা কিনে নেয়। নরেন বিজয়ার বাড়িতে যতবার এসেছে, বিজয়া ওকে খুব যত্ন করে খাওয়াত ঠিক হিন্দু পরিবারের রমনীদের মতোই। বিজয়ার আন্তরিকতায় নরেন মুগ্ধ হত, অবাক হত। কিন্তু যতবার তাদের দেখা হত, বিজয়া অনিচ্ছা স্বত্তেও নরেনকে বিভিন্নভাবে কথা দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করত। আসলে বিজয়া রাসবিহারী আর বিলাসের খবরদারিতে এমন কোণঠাসা একটা অবস্থায় ছিল যে, নরেনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের সুযোগ তাঁর ছিল না, সেই অপ্রকাশিত আবেগের তীব্রতা বেরিয়ে আসত কখনো কোমল কখনো বা কঠোর আচরণ আর কথার মাধ্যমে, যা নরেনকে বার বার দ্বিধান্বিত করত।

 

আর এদিকে রাসবিহারী আর বিলাসের দুর্ব্যবহার, কৌশলী  এবং বাজে আচরণ আঘাতের পর আঘাত করে চলছিল বিজয়া-নরেনকে।

 

এর মাঝে অনেক ঘটনা, অনেক বিপর্যয় আসে তাদের জীবনে। বিজয়া হাজার বার তাঁর সিদ্ধান্ত বদলায়, দু;খ ক্লেশে জর্জরিত হয়, একাকী মনের সাথে যুদ্ধ করে অসুস্থ হয়, দিনশেষে তাঁর মন সেই নরেনেই আবদ্ধ থাকে।

 

সত্যি বলতে লেখকের নরেন চরিত্রটা শতভাগ নিখাদ, তাঁর মাঝে একবিন্দু পরিমাণ দোষ খুজে বের করা দায়! এতোটাই অমায়িক মানুষ সে, তাকে দেখে, তাঁর ব্যবহারেই যেন সবার রোগ সেরে যায়। মানুষটা এমন যে, বিজয়াকে অধিকার করবার যোগ্যতা এবং ক্ষমতা তাঁরই সবচেয়ে বেশি সেটা জেনেও এই দাবি নিয়ে যায় নি কখনো বিজয়ার কাছে, পাছে তাঁর ভালোবাসাকে দুরভিসন্ধি ভেবে বসে। আর নরেন খুব বেশি সরল হওয়ায় তাঁর প্রতি বিজয়া যে এতটা অনুরক্ত সেটাও বুঝে উঠতে পারেনি, বরং বার বার বিজয়ার ব্যবহারে আহত হয়ে, আবার আপ্যায়নে মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে গিয়েছে দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে। ছেলেটা পেট পুরে খেতে পারত না কখনো, তারপরও ছিল প্রবল এক আত্মসম্মানবোধ, আর এটিই তাকে সবচেয়ে বিশেষ করে তুলেছিল সবার কাছে।

 

আর বিজয়া চরিত্রের বিশেষত্বও লেখক অসাধারণরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন পুরো উপন্যাস জুড়ে। বিজয়ার বাবা বনমালী যে, কন্যাকে ভরসা করে ভুল করেন নি সেটা বার বারই তাঁর আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। প্রজাদের প্রতি মমত্ববোধ, চাকরদের প্রতি আন্তরিক আচরণ, রাসবিহারী আর বিলাসের অন্যায় আচরণে কাঠিন্য প্রকাশ এবং তীব্র প্রতিবাদ, সবার প্রতি যত্নশীলতা ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়েই নারী হিসেবে তাকে পরিপূর্ণ এবং বিশেষ একজন করে তুলেছিল, যাকে আদর্শ বাঙালী নারীরূপ বলে ধরা যায়।

 

তবে বিজয়া একটা দিকে প্রায় হারতেই বসেছিল, তাঁর এই দ্বিধা এবং ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া সারাজীবন নষ্ট করে দিত হয়ত।

 

বিজয়া নরেনের পাওয়া চিঠির (যা জগদীশ এবং বনমালীর মাঝে আদানপ্রদান হয়েছিল) মাধ্যমে জানতে পারল, তাঁর বাবা আসলে চেয়েছিলেন নরেনের সাথে তাঁর বিয়ে দিতে, তাই নরেনকে তাঁর উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছিলেন, আর বন্ধকি বাড়িটা কখনোই ফিরিয়ে নিতে চান নি বরং জামাতাকে উপঢৌকন হিসেবে দিতে চেয়েছিলেন। চিঠি পড়ার পর সে যদিও সব বুঝেছিল, এতো পরে সব জেনে কষ্ট পেয়েছিল, নিজের করণীয় জেনেছিল, কিন্তু তারপরও নরেনকে ভুল বুঝে সে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। বিলাসের সাথে তাঁর বিয়েতে সম্মতি দিয়ে সইও করে দিয়েছিল নিমন্ত্রন পত্রে!!

 

তবে ভাগ্যিস তখন ব্রাক্ষ্মমন্দিরের আচার্য দয়ালবাবু সব জেনে বুঝে তাদের জন্য ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন, বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন অবোধ দুই প্রণয় প্রার্থীর ভালোবাসা। সবশেষে দয়ালের না জানিয়ে হঠাত আয়োজিত বিয়ের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল বিজয়া-নরেনের এই অমর প্রেমের উপাখ্যান!


Spread the love
খাতুনে জান্নাত আশা
This is Khatun-A-Jannat Asha from Mymensingh, Bangladesh. I am entrepreneur and also a media activist. This is my personal blog website. I am an curious woman who always seek for new knowledge & love to spread it through the writing. That’s why I’ve started this blog. I’ll write here sharing about the knowledge I’ve gained in my life. And main focus of my writing is about E-commerce, Business, Education, Research, Literature, My country & its tradition.
https://khjasha.com

Leave a Reply

Top
%d bloggers like this: