You are here
Home > দেশি পণ্য > ময়মনসিংহের সম্ভাব্য দশ জিআই পণ্য

ময়মনসিংহের সম্ভাব্য দশ জিআই পণ্য

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ময়মনসিংহ জেলা এক সময় সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তর জেলা ছিল। এর বিশালতা শুধু আয়তনেই ছিল তা নয়, বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা সবদিকেই এটি প্রাচীনকাল থেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ একটি জেলা ছিল। বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন “ময়মনসিংহ গীতিকা” আন্তর্জাতিক ভাবে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে, যা ময়মনসিংহ জেলার পাশাপাশি আমাদের পুরো দেশের জন্যই গর্বের কারণ। এছাড়াও সুবিস্তৃত পলিবাহী ব্রহ্মপুত্র নদ তীরবর্তী ময়মনসিংহ জেলার উর্বর মাটি, পানি, জলবায়ু, প্রকৃতি এ জেলার জনপদকে প্রাচীনকাল থেকেই অনেক প্রাচুর্য আর বিশেষত্ব দিয়েছে। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জেলায় উৎপাদিত বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেক পণ্যই রয়েছে, যা ময়মনসিংহের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই স্বীকৃতি লাভের যোগ্যতা রাখে। এই পণ্যগুলো প্রাচীনকাল থেকে যেমন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে, তেমনি ভাবে এগুলোর জিআই সনদ প্রাপ্তি অদূর ভবিষ্যতেও এ জেলার অর্থনীতিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করে তুলবে বলে আশা করা যায়। এই আর্টিকেলে ময়মনসিংহের বিশেষ এমন ১০টি পণ্যের জিআই সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। জিআই স্বীকৃতি লাভের জন্য যে সুনাম জনপ্রিয়তা দরকার, কয়েক দশকের যে ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা দরকার, যে আঞ্চলিক বিশেষত্ব থাকা দরকার এর সবই এই পণ্যগুলোতে বিদ্যমান আছে। 

১. মুক্তাগাছার মন্ডা

মন্ডা নামের এই মিষ্টান্নের জন্মই হয়েছে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলায় এবং প্রায় ২০০ বছর ধরে এটি একই রকম জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। সেই জমিদারি শাসনামল থেকে বিভিন্ন বিদেশি সফরে নিয়ে যাওয়া উপঢৌকনে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের আপ্যায়ন, আতিথেয়তা ইত্যাদির প্রধান অনুষঙ্গে মুক্তাগাছার মন্ডার ব্যবহার হওয়ায় শুধু দেশেই না মুক্তাগাছার মন্ডার সুনাম ছড়িয়ে পরেছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর এসব ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণগুলোই মন্ডাকে বাংলাদেশের ক্লাসিক ফুডের মর্যাদা দিয়েছে। তাই এর ভালো রকম রপ্তানি সম্ভাবনাও রয়েছে। 

মুক্তাগাছার এই মন্ডার আদলে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্ডা তৈরি করা হলেও, সেগুলোতে মুক্তাগাছায় তৈরি মন্ডার স্বাদ পাওয়া যায় না। এর অন্যতম কারণ হলো মন্ডা তৈরির প্রধান উপকরণ গরুর দুধ স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত হয়, যার সাথে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক বিশেষত্ব যুক্ত হয়ে যায়। এছাড়াও এর ২০০ বছরের পুরনো রেসিপি, তৈরির পদ্ধতি এবং কারিগরি দক্ষতাও এর বিশেষ স্বাদের বড় একটা কারণ। তাই মুক্তাগাছার মন্ডা অবশ্যই এ অঞ্চলের জিআই পণ্য হওয়ার দাবিদার। 

ইতিমধ্যেই মুক্তাগাছার মন্ডার জিআই আবেদনের জন্য ড্রাফট ডকুমেন্টও জমা দেয়া হয়েছে মুক্তাগাছার উপজেলা প্রশাসকের কাছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই এর আবেদন প্রক্রিয়ার কাজ সমাপ্ত হবে এবং এটি ময়মনসিংহ জেলার প্রথম জিআই পণ্যের মর্যাদা লাভ করবে। 

২. ময়মনসিংহের বিরই চাল 

বাংলাদেশের বহুল প্রচলিত একটি আদি দেশিয় জাতের ধান হলো বিরই। এদেশে হাজার বছর ধরে বিরই ধান মূলত বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের উঁচু জমিতে আবাদ হয়ে আসছে। ময়মনসিংহ জেলার স্থানীয় জাতের জনপ্রিয় ধান এবং চাল বলতেই বিভিন্ন প্রাচীন বই, জার্নাল ইত্যাদিতে বিরই ধানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এক সময় ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে বিরই ধানের চাষ হত, যা অন্যান্য স্থানীয় জাতের ধানের মতোই বর্তমানে বিলুপ্ত হতে চলেছে। 

বিরই চাষ করা হয় আমন মৌসুমে, অগ্রহায়ণ মাসে পাকা ধান কাটা হয়,তাই একে আমন ধানও বলা হয়ে থাকে। বিরই চাল হয় চিকন, মাঝারি লম্বা এবং লাল রঙের। একে তাই লাল বিরইও বলা হয়ে থাকে। এই চালের ভাত খেতে খুব সুস্বাদু হয়। 

রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রচলনের আগে থেকেই এদেশে বিরই ধানের চাষ হয়ে আসছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের থেকে বিরই ধানের ফলন অনেক কম হয়, একর প্রতি মাত্র ১৮/২০ মন। রাসায়নিক সার, কীটনাশক দিয়েও এর ফলন বাড়ানো যায় না বিধায় বিরই ধান সম্পূর্ণ অর্গানিক উপায়ে চাষ করা হয়। আর তাই বিরই চাল অধিক নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর।

সারাবিশ্বেই বর্তমানে অর্গানিক খাবারের চাহিদা অনেক গুন বেড়েছে, যা অর্গানিক বিরই চালের রপ্তানি সম্ভাবনাকেও ব্যাপকতা দিয়েছে। ময়মনসিংহের বিরই চাল জিআই হলে এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যকর বিশেষ চাল হিশেবে এর উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি এই চাল রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। যা দেশের বর্তমান রিজার্ভ সংকট নিরসনেও বেশ ভালো ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। 

৩. গফরগাঁও এর বেগুন

প্রাচীনকাল থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষের মাঝে ময়মনসিংহ জেলা বেগুন উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিল। আলাদা স্বাদ এবং বিশেষত্বের জন্য এই অঞ্চলের বেগুন এতোটাই জনপ্রিয় ছিল যে, পশ্চিম ময়মনসিংহের সবচেয়ে প্রাচীন শহরের নামই হয়ে উঠেছিল বাইগুনবাড়ি (ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় বেগুনকে বাইগুন বলা হয়)। এই বাইগুনবাড়ি থেকেই সারা ভারতবর্ষে তখন বেগুন রপ্তানি হত। আর ময়মনসিংহ জেলায় সবচেয়ে ভালো জাতের বেগুন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত হলো গফরগাঁও উপজেলা। গফরগাঁও এর লাফা বা তাল বেগুন নামের স্থানীয় জাতের গোল বেগুনের সুনাম সারাদেশ জুড়েই। এক সময় গফরগাঁও এর এই বিখ্যাত গোল বেগুন স্টেশনেই বিক্রি করা হতো এবং ট্রেনের মাধ্যমে সারাদেশেই মানুষ এগুলো কিনে নিয়ে যেতো। নদীভাঙন এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভয়াবহতায় স্থানীয় লাফা বেগুনের প্রাচীন সেই জাত এখন বিলুপ্ত হলেও এই এলাকার বেগুনের বিশেষত্ব আজও বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানেও গফরগাঁও এর ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী চরাঞ্চলগুলোতে প্রচুর পরিমাণে গোল বেগুন উৎপাদিত হয় যেগুলো আকার, আকৃতি এবং স্বাদের দিক থেকে একদমই আলাদা। তাই সারাদেশেই এই অঞ্চলের বেগুন সরবরাহ করা হয়ে থাকে। 

যে কোনো কৃষি পণ্যের জিআই স্বীকৃতির সাথে একদম প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষদের জীবনযাত্রার উন্নতি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি জড়িয়ে থাকে। গফরগাঁও এর বেগুন জিআই স্বীকৃতি পেলে তাই এই অঞ্চলের বেগুন আলাদা ভাবে পরিচিত হবে, কৃষকরা বেগুনের ন্যায্য দাম পাবে, সারাদেশে গফরগাঁও এর বেগুনের চাহিদা আরও বাড়বে, উৎপাদন বাড়বে, রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে এবং এভাবে পুরো অঞ্চলের অর্থনীতিতে এটি ভালো রকম অবদান রাখতে পারবে। 

ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগুলোতে বাইগুন বা বেগুনের উল্লেখ আছে, তাই এর ঐতিহ্যের প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীনতার সময়কার নায়করাজ রাজ্জাক অভিনিত একটা বাংলা সিনেমাতে গফরগাঁও এর বেগুনের জনপ্রিয়তা দৃশ্যমান হয়েছে। তাই বলা যায় এই অঞ্চলের বেগুনের সাথে সাংস্কৃতিক একটা সংযোগও এভাবে তৈরি হয়ে গেছে। এছাড়াও ময়মনসিংহের প্রাচীন ইতিহাসের আরও বই পুস্তকে গফরগাঁও এর বেগুনের কথা বার বারই এসেছে। ঐতিহ্যগত দিক থেকে যেহেতু এই অঞ্চলের বেগুন এতোটা সমৃদ্ধ, তাই এর জিআই প্রাপ্তি নিয়ে আমাদের চেষ্টা করা উচিত অবশ্যই যেনো অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও এই বিশেষ বেগুনের স্বাদ নিতে পারে।

৪. ময়মনসিংহের মালাইকারি

মালাইকারি মিষ্টির কথা বললে প্রথমে ময়মনসিংহের নাম বলতেই হবে, কারণ ময়মনসিংহ সদরেই এই মিষ্টির উৎপত্তি। সারাদেশে মালাইকারি ময়মনসিংহের বিখ্যাত মিষ্টি হিশেবে ভীষণ জনপ্রিয়। তাই এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি দেশের বাইরেও মালাইকারি ক্রেতা এবং ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে পৌঁছে যায়। বিভিন্ন নিউজ আর্টিকেল থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ৪০ বছরেরও বেশি আগে ময়মনসিংহের সুধির ঘোষের হাত ধরে মালাইকারির জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে জমিদারি শাসনের সময়টায় ময়মনসিংহে মালাইকারি প্রথম তৈরি করেছিলেন জানকি নাগ নামের একজন। দুই রকম তথ্য পাওয়া গেলেও মালাইকারির জন্ম ময়মনসিংহে এ নিয়ে কোনো দ্বিধার সুযোগ নেই এবং এই অঞ্চলের নামের সাথে এর নাম কয়েক দশক ধরে বেশ শক্তভাবেই জড়িয়ে গিয়েছে। ময়মনসিংহ ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এমন অসাধারণ স্বাদের মালাইকারি পাওয়া যায় না বলেই মিষ্টিপ্রেমি ক্রেতাদের অভিমত। এছাড়া মালাইকারি তৈরির প্রধান উপাদান হিশেবে যে দেশি গরুর খাঁটি দুধ দরকার হয়, তা ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী চরাঞ্চল থেকে সংগৃহীত হয় যার সাথে এ অঞ্চলের ভৌগোলিক বিশেষত্ব জড়িয়ে যায়। তাই ময়মনসিংহের মালাইকারি অন্যতম সম্ভাবনাময় একটি জিআই পণ্য। এর জিআই আবেদনের জন্য ইতিমধ্যেই ড্রাফট ডকুমেন্টও তৈরি করা হয়ে গেছে, ডিপিডিটির কার্যালয়ে জমাও দেয়া হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত এর জিআই আবেদন প্রক্রিয়ার কাজও শুরু হয়ে যাবে। 

৫. ফুলবাড়িয়ার হলুদ 

সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের হলুদ হিশেবে সারাদেশেই ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার হলুদের সুনাম রয়েছে। ফুলবাড়িয়ার পাহাড়ি অঞ্চলের লাল মাটি হলুদ উৎপাদনের জন্য আদর্শ। এই অঞ্চলে তাই হলুদের ফলন যেমন বেশি হয়, তেমনি স্বাদ, গন্ধ ও রং এর দিক থেকেও অন্যান্য অঞ্চলের হলুদ থেকে আলাদা এবং অতুলনীয়। এ বছর ফুলবাড়িয়া উপজেলার বাকতা, কালাদহ, নাওগাঁও, রাঙামাটিয়া, ভবানীপুর, রাধাকানাই, আছিম পাটুলি ও এনায়েতপুর ইউনিয়নের ১ হাজার হেক্টর জমিতে হলুদের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এ বলেন বছর হলুদ চাষিরা ৫ হাজার মেট্রিক টন হলুদ শুকিয়ে ঘরে তুলবেন যার বাজার মূল্য প্রায় ৬০ কোটি টাকা। এতেই বোঝা যায় এই অঞ্চলে উৎপাদিত হলুদ অত্র অঞ্চল তথা পুরো দেশের অর্থনীতিতে বেশ ভালোই অবদান রাখছে। তবে আমাদের দেশে চাহিদা অনুযায়ী হলুদের উৎপাদন অপর্যাপ্ত হওয়ায় অনেক হলুদ আমদানি করা হয়। তবে ফুলবাড়িয়ার সেরা মানের এই হলুদ জিআই স্বীকৃতি পেলে এর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির সুযোগও তৈরি করতে পারবে বলে আশা করা যায়। 

৬. ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি 

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার লাল চিনির ঐতিহ্য ২০০ বছরের পুরনো। ফুলবাড়িয়ার ব্র‍্যান্ড পণ্য বলা যায় একে। আখ থেকে এই লাল চিনি তৈরি করা হয়। ফুলবাড়িয়ায় প্রচুর পরিমাণ আখ উৎপন্ন হয়। এই এলাকার কৃষকরা আখ চাষ এবং লাল চিনি তৈরি করা উভয় দিকেই অন্যান্য এলাকার কৃষকদের থেকে অনেক বেশি দক্ষ। সারাদেশে যেখানে আখ চাষ থেকে মাড়াই করা পর্যন্ত ১২-১৪ মাস সময় লেগে যায়, সেখানে ফুলবাড়িয়ার কৃষকরা মাত্র ৯ মাসে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। এটি এই এলাকার কৃষকদের বিশেষ দক্ষতা প্রমাণ করে। আখ মাড়াই এর পর লাল চিনি তৈরির কাজ শুরু হলে এই অঞ্চলে এক প্রকার উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। গরম গরম লাল চিনি খাওয়া, লাল চিনি দিয়ে ক্ষীর-পিঠা-পুলি তৈরি করে অতিথি আপ্যায়ন করা ইত্যাদির ধুম পরে যায়। ফুলবাড়িয়া এলাকায় লাল চিনিকে কেন্দ্র করে আলাদা একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলা যায়। লাল চিনি তৈরির কাজ অধিকাংশই বাড়িতে নারীরা করে থাকে, তাই এর মাধ্যমে নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। এখনো সনাতনী পদ্ধতিতে হাতের ব্যবহারেই বেশির ভাগ লাল চিনি তৈরি হয়, যা অধিক স্বাস্থ্যকর। এছাড়াও সাদা চিনির তুলনায় লাল চিনিতে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকায় এটি অধিক স্বাস্থ্যকর। সাদা চিনিতে শুধু শর্করা ও সামান্য আয়রন ছাড়া আর কিছু নেই। অন্যদিকে লাল চিনিতে শর্করা ছাড়াও রয়েছে প্রোটিন, ফ্যাট, বিভিন্ন খনিজ লবণ ও ভিটামিন। লাল চিনিতে অধিক পরিমাণে গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ থাকার কারণে তা দেহে সরাসরি শক্তি জোগায়। লাল চিনির মোলাসেস অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এতে বিদ্যমান ফলিক এসিড দেহে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে। এ চিনি দেহের রক্তকণিকা তৈরিতেও সহায়তা করে। ক্ষুধামন্দা দূর করে। হজমে সহায়তা করে। আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ায় প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের জন্য লাল চিনি বেশ উপকারী। স্বাস্থ্য উপকারিতা থাকায় সারাবিশ্বেই লাল চিনি বা ব্রাউন সুগারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, তাই এর রপ্তানি সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিদেশে বেকারি দ্রব্য, কোমল পানীয়, দুগ্ধজাত দ্রব্য ও জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ বিভিন্ন কাজে ব্রাউন সুগার ব্যবহৃত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, জাপান, চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রাউন সুগারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফুলবাড়িয়ার লাল চিনি জিআই স্বীকৃতি পেলে, সঠিকভাবে এর ব্র‍্যান্ডিং করা হলে, সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি দেশের বৃহত্তর শিল্প খাতে পরিণত হবে এবং দেশের অর্থনীতিতে অনেক বেশিই অবদান রাখতে পারবে। 

৭. ময়মনসিংহের মৃৎশিল্প 

ময়মনসিংহের মৃৎশিল্পের ইতিহাস ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। মূলত পাল সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর প্রধান জীবিকার উৎস এই মৃৎশিল্প, আর এ জেলার প্রতিটি উপজেলায়ই পাল পাড়া রয়েছে, যাদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ মৃৎশিল্পের বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় এবং সৌখিন জিনিসপত্র তৈরি হয়ে আসছে। ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী চরাঞ্চল, সদরের বলাশপুর, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, ভালুকা, ফুপবাড়িয়া, গফরগাঁও, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরিপুর ইত্যাদি এলাকার অসংখ্য পাল পরিবার এই শিল্পের সাথে জড়িত। 

এদেশের লোকশিল্পের অন্যতম নিদর্শন এই মৃৎশিল্প, তাই দেশের প্রতিটি জেলায় মৃৎশিল্প গড়ে উঠেছে প্রাচীনকাল থেকেই। তবে প্রতিটি অঞ্চলের মৃৎশিল্পের বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষত্ব আলাদা। কারণ প্রতিটি অঞ্চলের মাটির ধরণ, মাটির জিনিসের ভিন্নতা, তৈরি পদ্ধতি এবং কারিগরদের দক্ষতায় অনেক পার্থক্য রয়েছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের মৃৎশিল্পেরও তাই আলাদা বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী এই জেলার মাটির গুনগত বৈশিষ্ট্য, আবার পাহাড়ি কিছু অঞ্চলের লাল মাটি এ এলাকার উৎকৃষ্ট মৃৎপণ্য তৈরির জন্য আদর্শ। এ এলাকার কুমাররা প্রয়োজনীয় মৃৎপণ্য তৈরির পাশাপাশি অনেক সৌখিন জিনিসও তৈরি করে থাকে। ত্রিশালের লক্ষীর সরা, প্রত্যেকটা উপজেলার মাটির পুতুল, বিভিন্ন খেলনা, ভাস্কর্য, বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গের প্রতিকৃতি ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়, দেশে বিদেশে এসব সৌখিন মৃৎপণ্যের অনেক চাহিদাও রয়েছে। ময়মনসিংহের শশীলজের সংগ্রহশালায় অসংখ্য মৃৎশিল্পের নিদর্শন রয়েছে, যেগুলো কয়েকশ বছরের পুরনো। এসব সৌখিন মৃৎশিল্প এই অঞ্চলের ঐতিহ্য বহন করে। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্প জিআই পণ্যের মর্যাদা পেলে এই অঞ্চলের হাজার হাজার পাল পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, যা ময়মনসিংহের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতেও ভালো রকম অবদান রাখতে পারবে।

৮. ময়মনসিংহের বাঁশ-বেত শিল্প

শত শত বছর ধরে বাঁশ-বেত শিল্পেও ময়মনসিংহ অঞ্চল অনেক সমৃদ্ধ। এ অঞ্চলের বাঁশ-বেত শিল্পের আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে, রয়েছে কারিগরদের বিশেষ দক্ষতা। ময়মনসিংহের প্রতিটি উপজেলায়, বিশেষ করে ময়মনসিংহ সদর, ঈশ্বরগঞ্জ, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, ত্রিশাল ইত্যাদি অঞ্চলের বাঁশ বেত শিল্প বেশ সমৃদ্ধ। বর্তমানে ঘর সাজানোর সৌখিন জিনিস এবং আসবাবপত্র হিশেবে বাঁশ-বেতের জনপ্রিয়তা শুধু বেড়েই চলেছে। ময়মনসিংহের সদরে তাই এই শিল্পের বেশ কিছু ছোট বড় দোকান এবং কারখানাও গড়ে উঠেছে, যেখানে আধুনিক রুচির শহরবাসী ভীড় জমায় চাহিদা মতো সোফাসেট, খাট, চেয়ার, টেবিল, দোলনা ইত্যাদি তৈরি করার জন্য।

ময়মনসিংহের এই শিল্পের সঠিক ব্র‍্যান্ডিং করা সম্ভব হলে এ জেলার বাইরেও এই শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব। এই অঞ্চলের বাঁশ-বেত শিল্পকে ঘিরে ই-কমার্সে উদ্যোক্তা তৈরি হলে, জেলার বাইরেও তৈরি পণ্যগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ময়মনসিংহের বাঁশ-বেত শিল্পের জিআই স্বীকৃতি এই শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বৃদ্ধি করবে এবং এর সাথে জড়িত প্রান্তিক মানুষগুলোর অবস্থার পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। 

৯. হালুয়াঘাটের গামছা 

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের হ্যান্ডলুম তাঁতশিল্প। আর এই অঞ্চলের তাঁত শিল্পের অন্যতম সেরা সৃষ্টি বলতে পারি আমরা হালুয়াঘাটের গামছাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তাঁতেই গামছা তৈরি হয়, তবে হালুয়াঘাটের গামছার বিশেষত্ব একদমই আলাদা। 

গামছা আসলে শুধু এক খন্ড কাপড়ের টুকরো নয়, এটি বাঙালি আবেগের সাথে জড়িত। গামছা বাঙালির তাঁত শিল্প এবং বস্ত্র সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। “গা মোছা” থেকে গামছা শব্দের উৎপত্তি হলেও শুধু গা মোছার কাজে গামছা কখনোই সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ গামছার ব্যবহারকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর বর্তমান যুগে তো গামছা আধুনিক ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে এর বিভিন্ন ফিউশন তৈরির মধ্য দিয়ে। গামছা দিয়ে শাড়ি, শার্ট, কুর্তি, থ্রিপিস, হিজাব, ব্যাগ ইত্যাদি এমন কিছু নেই যা তৈরি করা হয় না। হালুয়াঘাটের গামছা দিয়েও দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা অনেক ফিউশন ক্রিয়েট করেছে, যা এই অঞ্চলের গামছাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এসব ফিউশনের মাধ্যমে সারাদেশেই হালুয়াঘাটের গামছা নতুনভাবে পরিচিত হয়েছে, এর চাহিদা বেড়েছে। হালুয়াঘাটের গামছাকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিলে দেশে বিদেশে এর জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে, আরও উদ্যোক্তারা হালুয়াঘাটের গামছা ফ্যাশন নিয়ে উৎসাহী হবে। এর মাধ্যমে হালুয়াঘাটের তাঁতশিল্প অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবে, এই অঞ্চলের তাঁতিদের জীবন ব্যবস্থা উন্নত হবে। 

১০. গৌরিপুরের চল্লিশা আলু 

বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে আলু অন্যতম প্রধান খাদ্য। শর্করা জাতীয় খাবারের চাহিদা পূরণে এর জুরি নেই। বাংলাদেশে উৎপাদিত দেশি জাতের আলুর মধ্যে অন্যতম সেরা হলো চল্লিশা আলু, যা সর্বাধিক পরিমাণে উৎপাদিত হয় ময়মনসিংহের গৌরিপুরে। গৌরিপুরের চল্লিশা আলু নামেই এটি সারাদেশে বেশি জনপ্রিয়। চল্লিশা আলু স্বাদে সেরা তাই দামও অন্যান্য আলুর থেকে বেশি হয়। তবে যে কারণে এই আলু কৃষকদের কাছে অধিক জনপ্রিয়, তা হলো এটি স্বল্প সময়ে উৎপাদন করা যায়। অন্যান্য জাতের আলু চাষ করে ঘরে তুলতে ৯০দিন সময় লেগে গেলেও, চল্লিশা আলু মাত্র ৪০ দিনেই উত্তোলন করা সম্ভব হয়। তাই কৃষকরা এই আলু চাষে স্বল্প সময়ে অধিক লাভ করতে পারে, একই জমিতে বার বার ফসল ফলাতে পারে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও এখন তাই চল্লিশা আলুর চাষ বাড়ছে, গৌরিপুর থেকেই এই আলুর বীজ সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। শুধু চল্লিশা আলুর বীজ সরবরাহ করেই গৌরিপুরের অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকা যুক্ত হয়। তাই এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কৃষি পন্য হিশেবে এই গৌরিপুরের চল্লিশা আপু জিআই স্বীকৃতি লাভ করতে পারে। তাহলে দেশে এর চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। 

শেষকথা

উপরোক্ত সম্ভাব্য জিআই পণ্যগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ জড়িত। এই পণ্যগুলোর উৎপাদন এবং চাহিদা তাই যত বাড়বে, প্রান্তিক পর্যায়ের এই মানুষগুলোর জীবনযাত্রার মান তত বেশি উন্নত হবে। এটি জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে সম্প্রসারিত করবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করবে, উদ্যোক্তা তৈরি হবে, মানুষ উপার্জনের সন্ধানে ঢাকামুখী কম হবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে অনেক বড় অবদান রাখতে পারবে। এজন্যই অঞ্চলভিত্তিক এই বিশেষ জনপ্রিয় পণ্যগুলোর জিআই স্বীকৃতি খুব দরকার।

খাতুনে জান্নাত আশা
This is Khatun-A-Jannat Asha from Mymensingh, Bangladesh. I am entrepreneur and also a media activist. This is my personal blog website. I am an curious woman who always seek for new knowledge & love to spread it through the writing. That’s why I’ve started this blog. I’ll write here sharing about the knowledge I’ve gained in my life. And main focus of my writing is about E-commerce, Business, Education, Research, Literature, My country & its tradition.
https://khjasha.com

One thought on “ময়মনসিংহের সম্ভাব্য দশ জিআই পণ্য

  1. এই পণ্যগুলো ক্লাসিক হওয়ার কারণেই যুগের পর যুগ ধরে মানুষ উৎপাদন ও ব্যবহার করছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও বিক্রয় হলেও ই-কমার্সের মাধ্যমে তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে জেলার অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ রয়েছে। জিআই স্বীকৃতি পেলে প্রচার ও চাহিদা আরও বেড়ে যাবে। এতে করে জেলা ব্র্যান্ডিং ও কর্মসংস্থান বাড়বে অনেক বেশি। আশা আপুকে ধন্যবাদ বিষয়টি সকলের সামনে নিয়ে আসার জন্য এবং মন্ডাসহ অন্যান্য পণ্যের জিআই ডকুমেন্টেশন করার জন্য।

Leave a Reply

Top
%d bloggers like this: