
গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ নিয়ে গড়িমসি করা, অলসতা করার বাজে অভ্যাসটা আমাদের সবার মাঝেই কম বেশি আছে। আর বর্তমানে এমন একটা সময়ে আমরা বাস করছি যখন চারদিকে এতো এতো এক্সাইটিং প্রযুক্তি, সোসাল মিডিয়া আর ভাইরাল সব টপিক চোখের সামনে ঘুরে ফিরে আসে যে, কোনো একটা নির্দিষ্ট কাজে ফোকাসড থাকা অনেক বেশিই কঠিন মনে হয়। আমরা আসলে ইন্সট্যান্ট আনন্দ চাই, সহজ সুখ চাই।
এমন হয় যে, আমি জানি সামনে আমার এক্সাম পড়তে হবে বা অফিসে গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রজেক্ট জমা দিতে হবে। পড়া বা সেই কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস ভাবে বসিও, কিন্তু তৎক্ষনাৎ ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দে সাথে সাথে মনযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফোনটা হাতে নেই, নোটিফিকেশন চেক করার পর কারণ ছাড়াই সোসাল মিডিয়া স্ক্রল করতে করতে, রিল দেখতে দেখতে ঘন্টার পর ঘন্টা চলে যায়। কোনো একটা ভাইরাল টপিক দেখে মনে হয়, এটা নিয়ে আমারও পোস্ট করা উচিত, তাহলে এখন পোস্টের রিচ অনেক বাড়বে, অনেকের এটেনশন পাওয়া সহজ হবে। পোস্ট দিয়েই ক্ষান্ত হওয়া যাবে না, লাইক কমেন্ট বার বার চেক করতে হবে, রিপ্লাই দিতে হবে। মস্তিষ্ক কাজের কথা বার বার মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু আমরা তখন সেই সাময়িক আনন্দ থেকে মন কে কনট্রোল করতে পারি না, মস্তিষ্ককে এই বলে বোঝাই যে, কয়েকদিন সময় তো আছে এখনো আমার পড়ার বা প্রজেক্ট সাবমিশনের। এই ভেবে সারাদিন রাত চলে যায়। ভেতরে ভেতরে কিন্তু মানসিক অশান্তি ঠিকই কাজ করে আমাদের, অস্থিরতা কাজ করে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বা পড়া ফেলে রেখে সময় নষ্ট করছি তাই। তারপরও আমরা নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না, সহজ সুখ এবং আনন্দ পাওয়ার লোভ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারি না। এমনটা আসলে কেনো হয়? কীসের জন্য হয়?
এসবের মূলে আছে – ডোপামিন।
অনেকেই হয়তো জানি, কী এই ডোপামিন।
ডোপামিন হচ্ছে একটি নিউরোট্রান্সমিটার বা হরমোন যা ন্যাচারালি আমাদের ব্রেনে তৈরি হয়। আমাদের শারীরিক ব্যালেন্স ঠিক রাখতে এর গুরুত্ব আর কার্যকারিতা অনেক। ডোপামিন নিঃসরণের ফলে আমরা আনন্দিত হই, এক্সাইটেড ফিল করি, মোটিভেটেড হই। একে তাই রিওয়ার্ড হরমোন বা প্লেজার হরমোন নামেও ডাকা হয়।
আসলেই কী ডোপামিন আমাদের স্থায়ীভাবে সুখী করতে পারে? উত্তর হলো- না। বরং এটা একের পর এক উত্তেজনাকর কাজে আমাদেরকে উৎসাহিত করতে থাকে। আর যখন আমাদের একটা এক্সাইটিং টার্গেট ফুলফিল হয়ে যায়, তখন আমরা ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি। এর ফলে আমরা নতুন আরেকটা এমন টার্গেট নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাই। এক সময় আমরা ডোপামিনের প্রবাহ একদমই আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না, ডোপামিন নিঃসরণেও আর আনন্দ কাজ করে না, যা মানসিক ভাবে আমাদেরকে অসহায় করে তুলে, আমরা ডিপ্রেশনে চলে যাই। আমাদের আল্টিমেট লক্ষ্য উদ্দেশ্য থেকে আমরা ছিটকে পরি।
অতিরিক্ত কোনো কিছুই যে মঙ্গলজনক না তা তো আমরা সবাই জানি, ডোপামিনও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম না। অতিরিক্ত ডোপামিনের প্রবাহ আমাদেরকে কোনো কিছুর প্রতি অধিক আসক্ত করে, নেশাগ্রস্ত করে তোলে, বার বার এমন সব কাজে আমাদেরকে ব্যস্ত রাখতে উৎসাহিত করে যা থেকে খুব সহজে আনন্দ আর উত্তেজনা লাভ করা যায়। এভাবে অধিক এক্সাইটিং কাজ প্রতিনিয়ত করতে থাকলে অধিক পরিমাণে ডোপামিন নিঃসৃত হয়। এর ফলে একটু কঠিন, বোরিং এবং দীর্ঘস্থায়ী কাজের প্রতি অনীহা চলে আসে, খুব বেশি সময় মনযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয় না।
এজন্যই সোসাল মিডিয়া, অ্যালকোহল, বিভিন্ন গেইম, মুভি, টিভি সিরিজ, ক্যাফেইন, চিনিযুক্ত খাবার, ইউটিউব ভিডিও, মিউজিক ইত্যাদিতে আমরা খুব সহজেই আসক্ত হয়ে পরি, ফেইসবুক পোস্টে অনেক লাইক কমেন্ট পেতে অস্থির হয়ে পরি, গুরুত্বপূর্ণ কাজে বসে প্রতি মিনিটে মিনিটে ফোন চেক করি। এই বদ অভ্যাসগুলো আমাদেরকে অনেক বেশি পিছিয়ে দেয়। এর ফলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নিজের উপর আমরা রাগ করি, শূন্যতা অনুভব করি।
এইসব বদঅভ্যাস দূর করতে অতিরিক্ত ডোপামিন প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আর এজন্য যা দরকার তা হলো- “ডোপামিন ডিটক্স”। ডোপামিন ডিটক্স আমাদের অতিরিক্ত ডোপামিনের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে, বাঁধা দেয়, স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।
ডোপামিন ডিটক্স নেয়ার মানে হলো- এমন সব কাজ থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় বিরত রাখা যে সব কারণে আমাদের ডোপামিন প্রবাহিত হয়। ব্যাপারটা অনেকটা নিজেকে রিস্টার্ট দেয়ার মতো।
ডিটক্স নেয়ার অনেক ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি আছে, তবে “ডোপামিন ডিটক্স” বইটায় লেখক তিন ধরনের ডিটক্সকে ফোকাস করেছেন- ১) ৪৮ ঘন্টার ডোপামিন ডিটক্স ২) ২৪ ঘন্টার ডোপামিন ডিটক্স ৩) আংশিক ডোপামিন ডিটক্স।
৪৮ ঘণ্টা ডিটক্স নেয়ার মানে হলো, পুরো দুই দিন আপনি সব ধরনের এক্সাইটিং কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন যেগুলোর কারণে আপনার ডোপামিন প্রবাহিত হয়, ২৪ ঘন্টা ডিটক্স নেয়ার মানে হলো সেসব কাজ থেকে পুরো একদিন নিজেকে বিরত রাখা, আর আংশিক ডোপামিন ডিটক্স হলো, সুনির্দিষ্ট এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা যাতে আপনি অধিক আসক্ত, নেশাগ্রস্ত, যা আপনার অধিক ডোপামিন প্রবাহের কারণ।
আমাদের অধিকাংশই আসলে সবচেয়ে বেশি আসক্ত স্মার্টফোন আর সোসাল মিডিয়ার প্রতি। প্রতি সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টা/ অন্তত ২৪ ঘন্টা কী এগুলো থেকে দূরে থাকা আমাদের দ্বারা সম্ভব! অবশ্যই অসম্ভব কিছু না যদি আমরা সিরিয়াসভাবে চাই। কারণ এটা আমাদের জন্য খুব দরকার। ভালো কোনো কাজ, লেখালেখি, পড়াশোনা ইত্যাদির প্রতি নিজেদেরকে মনযোগী করে তুলতে, একদিকে ফোকাসড থাকতে অবশ্যই ডোপামিন ডিটক্স নেয়া দরকার আমাদের।
“ডোপামিন ডিটক্স” বইয়ে এ নিয়ে আরও চমৎকার ভাবে লেখক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বইটা পড়লে তাই আরও ক্লিয়ার আইডিয়া পাওয়া যাবে। এক বসায় পড়ে উঠার মতো মাত্র ৫০ পেইজের খুবই ছোট্ট একটা বই এটা। আশা করি পড়তে খুব ভালো লাগবে।
