
“বন-গেঁয়োরা ধান কেটে নেয় থাকতে মোরা গফর-গাঁয়ে,
এই কথা আজ শোনার আগে মরিনি ক্যান গোরের ছায়ে?”
পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থের খন্ড খন্ড অংশ আর সামারি বিভিন্ন সময় পড়া হলেও পুরো কাব্যগ্রন্থটা পড়ে শেষ করলাম মাত্র ক’দিন আগে। উদ্দেশ্য ছিল স্পেশালি আমাদের গফরগাঁও এর সম্ভাব্য জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) পণ্যের রেফারেন্স খুঁজে বের করা।
স্কুলে পড়ার সময় আমাদের প্রায় সবারই গল্পের নায়ক রুপাই এর সাথে পরিচয় ঘটেছিল পাঠ্যবই এর সংক্ষিপ্ত কবিতার মাধ্যমে। এর প্রেক্ষাপট পুরোটাই আমাদের গফরগাঁও এ জানলেও কাব্যগ্রন্থে সরাসরি গফরগাঁও এর নাম উল্লেখ আছে এটা জানতাম না। সেদিন পড়তে গিয়ে উপরের এই উক্তিটায় সরাসরি এর নাম খুঁজে পেয়ে খুব বেশি ভালো লাগছিল। সেই সাথে বনগাঁও আর মামুদপুর নামের দুই এলাকার নামও আছে, যেগুলো খুব পরিচিত নাম, চেনা অনেক মানুষ থাকে এই এলাকাগুলোতে।
মূলত পাশাপাশি দুটি গ্রাম, দুই গ্রামের দুই কিশোর কিশোরীর পরিচয়, বিয়ের মাধ্যমে পরিণয়, হঠাৎ দুই গ্রামের দাঙ্গা হাঙ্গামা, অতঃপর তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্ছেদ, প্রতিক্ষা এবং মৃত্যুর গল্প নিয়েই এই কাব্য রচিত হয়েছে। আর এই পুরো গল্প স্বার্থকতা পেয়েছে রুপাই এর জন্য অপেক্ষমান সাজুর নকশী কাঁথা অঙ্কনের মাঝে গল্পটা জায়গা পাওয়ার মধ্য দিয়ে। শুরুটা অসাধারণ এবং উপভোগ্য আর শেষটা দুঃখের এবং মনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলার মতো। এটা ছোট্ট একটা ট্রাজিক প্রেমের উপাখ্যান, যা দ্রুত পড়ে শেষ করা গেলেও এর রেশ থেকে যাবে সারাজীবন।
নিজের এলাকার বলেই বুঝি পড়ার সময় কবিতার প্রতিটি লাইনের দৃশ্যপট চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলাম যেন। কারণ এই কাব্যে তুলে ধরা গ্রাম, এর মানুষ, কাব্যের নায়ক নায়িকা এবং তাদের গল্প অনেকাংশে বাস্তব। ভীষণ রকম ভালো লাগার এই অনুভূতি।
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বিশ্বের ৩৭টি ভাষায় অনূদিত এই বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থে কী কী পণ্যের রেফারেন্স খুঁজে পেলাম, সেটাই এখন কবিতার ছন্দে ছন্দে ধারাবাহিকভাবে লিখছি।
★ জিআই পণ্যের খুঁজে (নক্সী কাঁথার মাঠ- জসীম উদদীন) পর্ব – ১
এই কাব্যের প্রথম দৃশ্যায়নে পাশাপাশি দুইটি গ্রামের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যার প্রথম দুই লাইনেই একটা পণ্যের রেফারেন্স পেয়েছি।
(১)
“এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও- মধ্যে ধু ধু মাঠ,
ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।”
প্রথম দৃশ্যায়নের শেষ দুই লাইন –
“দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা,
এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা।”
‘কাউন’ আমাদের গফরগাঁও এ অনেক হতে দেখেছি এক সময়। এই কাব্যের প্রেক্ষাপট গফরগাঁও অঞ্চলের, আর প্রথমেই ধানের সাথে কাউনের কথা এসেছে। এর মানে এই অঞ্চলের উৎপাদিত অন্যতম প্রধান শস্য ছিল এটা বলা যায়। পুরো ময়মনসিংহেরই চরাঞ্চলে প্রচুর কাউন হতো। এখন এই শস্য প্রায় বিলুপ্ত হতে চললেও স্বল্প পরিসরে এখনো চাষ হয় আমাদের এলাকায়। দেশের বাইরেও ভালো রকম চাহিদা রয়েছে কাউনের। এটা তাই অন্যতম সম্ভাবনাময় একটা জিআই পণ্য। আর কাউনের পায়েস তো আমার অসম্ভব রকম পছন্দের। এটা জিআই হলে ভীষণ ভালো লাগবে।
(২)
“এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে,
জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে!”
‘পদ্ম’ ফুল হিশেবে বাংলাদেশের জিআই হতে পারে। শুধু এই নক্সী কাঁথার মাঠ কাব্যে না পুরো ময়মনসিংহ গীতিকা পড়তে গিয়ে প্রতিটি পালায় অসংখ্য অসংখ্য বার পদ্মফুলের কথা পাচ্ছি। আমাদের দেশ হাওড়, বাওড়, খাল-বিল, নদী-নালা প্রধান হওয়ায় এদেশ পদ্মের জন্য আদর্শ জায়গা। আর পদ্মফুলের আঁশ থেকে অনেক দামি সিল্ক সুতা উৎপন্ন করা যায়। বাংলাদেশে পদ্মফুলের আঁশ থেকে বানিজ্যিক ভাবে সুতা উৎপাদন শুরু করা গেলে এই ফুলের গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে এবং দেশের রপ্তানিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে এটি।
(৩)
“কেইবা জানে হয়তো তাদের মাল্য হতেই খসি,
শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি।”
‘শাপলা’ আমাদের জাতীয় ফুল। এটা অবশ্যই জিআই হওয়ার দাবিদার। আর শাপলা শুধু মাত্র আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ধনকারি ফুলই না, এটা দেশের অসংখ্য নিম্নবিত্ত মানুষের আয়ের উৎস। কারণ তরকারি হিশেবে শাপলার বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে এবং এটা অনেক পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। শাপলার শালুক বেশ জনপ্রিয় গ্রামাঞ্চলে, এখন শহরের বাজারগুলোতেও শাপলার মৌসুমে এটা বিক্রি করা হয় ভালো রকম চাহিদা থাকার কারণে। তাই এটা নিঃসন্দেহে জিআই হতে পারে এবং অবশ্যই রপ্তানিযোগ্য পণ্য।
★ জিআই পণ্যের খুঁজে (নক্সী কাঁথার মাঠ- জসীম উদদীন) পর্ব -২
এই কাব্যের ২য় দৃশ্যায়নে নায়ক রুপাই এর বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি বেশ কিছু উপমাসূচক শব্দের উল্লেখ করেছেন, যাতে কয়েকটি জিআই পণ্যের রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যায়-
(১)
“জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু,”
‘লাউ’ বাংলাদেশের বেশ জনপ্রিয় সবজি। এর জন্ম আফ্রিকায় হলেও এদেশে এটি হাজার বছর ধরে চাষ হচ্ছে। লাউ শরীর শীতল করে, এটি পুষ্টিকর এবং ঔষধিগুনও রয়েছে এর মাঝে। সবজি হিশেবে এটি আমাদের জিআই হতেই পারে।
(২)
“সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ,
কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক।”
‘পিতল’ এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত ধাতব উপকরণ। নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের পাশাপাশি অনেক সৌখিন এবং শৈল্পিক জিনিসপত্র তৈরি হয় এই পিতল থেকে, সারাবিশ্বেই ভালো রকম চাহিদা আছে এগুলোর। তাছাড়া পিতলের যে কোনো ব্যবহার্য জিনিস বেশ স্বাস্থ্যকর। আমাদের দেশের কাঁসা-পিতল শিল্পকে একসাথে করে সব সময় বলা হলেও দুইটার আলাদা শিল্প মূল্য রয়েছে। পিতল শিল্প বাংলাদেশের জিআই হতে পারে।
(৩)
“আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী,
খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি।”
‘বাঁশের লাঠি’ এখানে আমাদের দেশের বাঁশ শিল্পের ঐতিহ্য ধারণ করছে। বাঁশ অনেক বেশি প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ, যা দিয়ে প্রায় শত রকমের জিনিস তৈরি হয়ে থাকে। বাঁশ দিয়ে তৈরি নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র আর আসবাবে থাকে শিল্পের ছোঁয়া, যা বাঙালি ঐতিহ্যের ধারক। আমাদের দেশি জাতের বিভিন্ন বাঁশের নামও এই কাব্যের পরবর্তী দৃশ্যায়নের এসেছে। তাই বলা যায়, আমাদের দেশি জাতের বাঁশ এবং বাঁশ শিল্প আলাদা আলাদা জিআই হওয়ার দাবিদার।
(৪)
“জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে,
‘শাল-সুন্দী-বেত’ যেন ও, সকল কাজেই লাগে।”
‘শাল-সুন্দী-বেত’ এখানে রুপাই সর্বগুনে গুনান্বিত উপমায় ব্যবহার হয়েছে। এখানে ৩টা পণ্যের নাম আছে- শাল গাছ, সুন্দী বা শ্বেতপদ্ম এবং বেত। এই উপমার মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, এই পণ্যগুলো খুব বেশিই গুরুত্বপূর্ণ, এগুলোর উপর মানুষের নির্ভরতা অনেক বেশি ছিল, এগুলো মানুষের অনেক কাজে লাগত। শাল গাছের জন্মস্থান ভারতবর্ষেই, এদেশে প্রচুর শাল বৃক্ষ রয়েছে এবং একে একটি অর্থকরী বৃক্ষই বলা যায়। শাল গাছ প্রাচীন কাল থেকে ঔষধি বৃক্ষ হিশেবেই বেশি পরিচিত ছিল। এছাড়াও এর পাতা, বাকল, কান্ড প্রত্যেকটা অংশের আলাদা আলাদা গুরুত্ব এবং ব্যবহার রয়েছে। শ্বেতপদ্মও এর ঔষধি গুনের জন্যই বেশি পরিচিত ছিল প্রাচীনকাল থেকেই আর বেত পণ্যের ব্যবহার আমাদের দেশে কতটা বিস্তৃত তা তো আমরা সবাই জানি। সুতরাং কবিতার এই একটা লাইনকে ৩টা ভিন্ন ভিন্ন জিআই পণ্যের রেফারেন্স বলা যায়।
কাব্যেটির ৩য় দৃশ্যায়নে নায়িকা সাজুর রূপ গুনের বর্ণনা পড়তে পড়তে আরও কয়েকটি জিআই পণ্যের রেফারেন্স খুঁজে পেলাম-
(৫)
“ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে,
ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে;”
‘ছন’ হতে পারে আমাদের জিআই পণ্য। এক সময় গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে ছনের ঘর দেখা যেতো, যা এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু গ্রামের বদলে ছন এখন শহরে ঠিকই চোখে পরে। অনেক গ্রামের পুরনো ঐতিহ্যের আদলে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, আর ব্যক্তিগত বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ছনের ছাউনি, ছনের বেড়া, ছনের ঘর ইত্যাদি করে থাকে। দেখতে দারুণ লাগে, আলাদা একটা প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায় এই জায়গাগুলোতে। ছনের ঘরের ঐতিহ্য এভাবেই আমরা ধরে রাখতে পারি, আরও বড় পরিসরে এর ব্যবহার বাড়াতে পারি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে।
(৬)
“কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনায় খেলা,
তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা।”
‘তুলসী’ ভেষজ উদ্ভিদের মাঝে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই তুলসী ব্যবহার হয়ে আসছে। বানিজ্যিক ভাবেও এখন তুলসীর চাষ হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
একই লাইনে আরেকটা পণ্যের কথা আছে, সেটা হলো ‘প্রদীপ’। এদেশে প্রদীপের ব্যবহারও কম না, প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবহার হয়ে আসছে। দুইটা পণ্যের কথাই এখানে উপমার্থে আসলেও এ থেকে পণ্যগুলোর পরিচয় আমরা পাচ্ছি। এই দুইটা পণ্যই আমাদের জিআই হওয়ার মতো।
(৭)
“গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি,
চাষী মেয়ের রূপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি?”
এখানে ‘গাঁদাফুল’ আর ‘চাঁপা ফুল‘ এর কথা এসেছে। আমাদের দেশে প্রচুর ফুল উৎপাদিত হয়, প্রাচীনকাল থেকেই ফুল এদেশে কতোটা জনপ্রিয় ছিল তা বিভিন্ন সাহিত্য পড়লেই আমরা বুঝতে পারি। বানিজ্যিক ভাবেও প্রচুর ফুল চাষ হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিদেশেও এসব ফুল রপ্তানি হয়। ফুলের চাহিদা তো যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছেই। তাই অবশ্যই এই ফুলগুলো হতে পারে আমাদের জিআই।
(৮)
“রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ,
পাটের বনের বউ-টুবাণী, নাইক দেখার লোভ।”
‘পাট’ তো আমাদের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় জিআই পণ্য। বাংলাদেশের পাট পৃথিবী বিখ্যাত। এদেশে উৎপাদিত পাটের কোয়ালিটি সবচেয়ে সেরা, তাই সারাবিশ্বেই এর অনেক বেশি চাহিদা। পাটের কথা বললে ফুরাবে না আসলে। আমার মতে, বাংলাদেশের একটা পণ্য জিআই হওয়ার যোগ্য হলে সেটা হওয়া উচিত ‘বাংলাদেশের পাট’।
(৯)
“তাহার মতন চেকন ‘সেওই’ কে কাটিতে পারে,
নকসী করা ‘পাকান পিঠায়’ সবাই তারে হারে।
হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল,
এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল।”
‘সেওই’ বলতে এখানে হাতে তৈরি সেমাই পিঠার কথা বলা হচ্ছে। সারাদেশেরই গ্রামাঞ্চলে ইদ মৌসুমে এই হাতের সেমাই বানানোর ধুম পরে যায়। এখন অনলাইনের বদৌলতে শহরে বসেও গ্রামের হাতের সেমাই খেতে পারি আমরা। এর আরও চাহিদা বৃদ্ধি করা সম্ভব বানিজ্যিক উৎপাদনের মাধ্যমে। অবশ্যই আমাদের হাতের সেমাই জিআই হতে পারে।
‘পাকান পিঠা’ হলো আমাদের গফরগাঁও অঞ্চলের নকশী পিঠা। আমাদের অঞ্চলে এটা খুবই জনপ্রিয়, নরসিংদীর নকশী পিঠার সাথে এর বানানোর নিয়ম বা স্বাদে পার্থক্য নেই বলেই আমার মনে হয়। এসব পিঠাও অনলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে বিক্রি হয় এখন। পাকান পিঠা গফরগাঁও এর জিআই পিঠা হতে পারে।
‘চিত্র করা হাঁড়ি‘র কথা বলা হয়েছে এখানে, এটা সাধারণত মাটির হাঁড়িতেই করা হয়। চিত্র করা মাটির হাঁড়ি জিআই হতে পারে। আবার বলা হয়েছে ‘ফুল তোলা শিকে’র কথা। পাটের দড়ি বা পুরনো কাপড়ের ফালি দিয়ে এসব শিকে তৈরি করা হয়, যার চাহিদা বর্তমানে শহরেও বাড়ছে। ঘর সাজানোর জন্য শহরের বাসা বাড়িতে এসব ‘ফুল তোলা শিকে’ আর ‘চিত্র করা মাটির হাঁড়ি’র ব্যবহার বাড়ছে। বিদেশেও এসব সৌখিন জিনিসের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তাই এগুলোর ভালো রকম জিআই সম্ভাবনা রয়েছে।
★ জিআই পণ্যের খুঁজে (নক্সী কাঁথার মাঠ- জসীম উদদীন) পর্ব -৩
এই কাব্যের ৪র্থ দৃশ্যায়নে বর্ণিত হয়েছে বৃষ্টিহীন উত্তপ্ত চৈত্র বৈশাখের ভয়াবহতা। দুই মাস টানা বৃষ্টি না হওয়ায় গ্রামগুলোতে হাহাকার অবস্থা হয়েছিল। এমন অবস্থায় এক সময় গ্রামে বৃষ্টি নামানোর জন্য বিভিন্ন রীতি নিয়ম প্রচলিত ছিল, এটাও অনেকটা উৎসবের মতো ছিল, যা কবি দারুণ ভাবে বর্ণনা করেছেন এই অংশে। আর এই দৃশ্যেই কিন্তু আমাদের কাব্যের নায়ক রুপাই নায়িকা সাজুর প্রেমে পরে যায় প্রথম দেখাতেই।
যাই হোক, এটুকু পড়তে পড়তে যেসব পণ্যের রেফারেন্স পেয়েছি সেগুলো তুলে ধরছি এখন।
(১)
“কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া,
তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া!
আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি,
নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি।
কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়,
আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়!”
‘কাজল, টিপ, নোলক, সিঁদুর’… এই ৪টা পণ্যের প্রত্যেকটাই হাজার বছর ধরে বাঙালি ঐতিহ্য সংস্কৃতির অংশ হয়ে আছে। এগুলো আমাদের জিআই হতে পারে।
(২)
“রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান,
রূপাই বলে, “এই দিলে মা থাকবে না আর মান।”
ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল,
সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল।”
‘সোনা মুগ ডাল’ আমাদের দেশি জাতের ডাল। আমাদের অঞ্চলে এটা ভালোই চাষ হত সেই সময় কবিতার এই লাইন থেকেই বুঝতে পারছি। বাংলাদেশ থেকে এখন প্রচুর মুগ ডাল বিদেশে রপ্তানি হয়। আমাদের স্থানীয় জাতের এই সোনা মুগ ডাল অনেক বেশিই পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর, তাই এর চাহিদাও আরও অনেক বৃদ্ধি করা সম্ভব। অবশ্যই এই সোনা মুগ ডাল জিআই হতে পারে।
কাব্যের ৫ম দৃশ্যায়নে রুপাই সাজুর দ্বিতীয় বার দেখা হওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এখানে অনেকগুলো পণ্যের নাম উঠে এসেছে।
(৩)
ওগাঁর বাঁশ দশটা টাকায়, সে-গাঁয় টাকায় তেরো,
মধ্যে আছে জলীর বিল কিইবা তাহে গেরো |
বাঁশ কাটিতে চলল রূপাই কোঁচায় বেঁধে চিঁড়া,
দুপুর বেলায় খায় যেন সে—মায় দিয়াছে কিরা |
মাজায় গোঁজা রাম-কাটারী চক্ চকাচক্ ধার,
কাঁধে রঙিন গামছাখানি দুলছে যেন হার |
মোল্লা-বাড়ির বাঁশ ভাল, তার ফাঁপগুলি নয় বড় ;
খাঁ-বাড়ির বাঁশ ঢোলা ঢোলা, করছে কড়মড় |
সর্ব্বশেষে পছন্দ হয় খাঁ-বাড়ির বাঁশ :
ফাঁপগুলি তার কাঠের মত, চেকন-চোকন আঁশ |
এমন সময় পিছন হতে তাহার মায়ে ডাকে,
“ওলো সাজু! আয় দেখি তোর নথ বেঁধে দেই নাকে!
ওমা! ও কে বেগান মানুষ বসে বাঁশের ঝাড়ে!”
মাথায় দিয়ে ঘোমটা টানি দেখছে বারে বারে |
বাঁশ কাটিতে রূপার বুকে ফেটে বেরোয় গান,
নলী বাঁশের বাঁশীতে কে মারছে যেন টান!
বেছে বেছে কাটল রূপাই ওড়া-বাঁশের গোড়া,
তল্লা বাঁশের কাটল আগা, কালধোয়ানির জোড়া ;
বাল্ কে কাটে আল্ কে কাটে কঞ্চি কাটে শত,
ওদিক বসে রূপার খালা রান্ধে মনের মত |
যাহোক রূপা বাঁশ কাটিয়া এল খালার বাড়ি,
বসতে তারে দিলেন খালা শীতল পাটি পাড়ি |
উপরের সবগুলো লাইন থেকে পাওয়া পণ্যগুলোর বর্ণনা এখানে দিচ্ছি এখন-
• এখানে খেয়াল করে দেখেন অনেকগুলো স্থানীয় জাতের বাঁশের নাম তুলে ধরেছেন কবি একদম সেগুলোর বৈশিষ্ট্য সহ। ওগাঁর বাঁশ, নলী বাঁশ, ওড়া-বাঁশ, তল্লা বাঁশ ইত্যাদি প্রত্যেকটা বাঁশের জাত সম্পর্কে ধারণা হয়ে যায় এই কয়েকটা লাইন থেকেই। বাঁশের উপর প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমরা অনেক বেশি নির্ভরশীল। এখন তো আরও প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি সৌখিনতা আর আভিজাত্যের চর্চায়ও বাঁশের ব্যবহার বাড়ছে। অবশ্যই বাংলাদেশের বাঁশ জিআই হওয়া উচিত।
• ‘চিঁড়া’ অনেক স্বাস্থ্যকর একটা খাবার, যা আমরা অনেক ভাবে খেয়ে থাকি। দই-চিড়া, গুড় চিড়ার গুড়া আর চিড়া ভাজা অনেক জনপ্রিয় সব ধরনের মানুষের কাছেই। আমাদের দেশি জাতের ধানগুলো থেকে সুস্বাদু চিড়া উৎপন্ন হয়। বিশেষ করে দিনাজপুরের কাটারি চিড়ার আলাদা কদর রয়েছে, যা সম্ভাব্য জিআই হিশেবে অনেক এগিয়ে। এছাড়াও আমাদের দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদিত বিভিন্ন দেশি ধানের চিড়া জিআই হতে পারে।
• ‘গামছা‘ আমাদের দেশি তাঁতের অন্যতম আকর্ষনীয় একটা ক্রিয়েশন, যা শত শত বছর ধরে একান্তই আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য হিশেবে বুনন এবং ব্যবহার হয়ে আসছে। আমাদের দেশের প্রত্যেকটা অঞ্চলের তাঁতের গামছারই আলাদা আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। আর রঙিন গামছাগুলো এখন আর গামছাতেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং আধুনিক ফ্যাশনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। শাড়ি, থ্রিপিস, হিজাব, শার্ট, ব্যাগ, জুতা, গয়না ইত্যাদি কী হয় না গামছা দিয়ে এখন তাই আমি ভাবার বিষয়। এসব বিভিন্ন ফিউশনের মাধ্যমে গামছা পণ্য বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকটা অঞ্চলের গামছাই আলাদা আলাদা জিআই হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
• ‘নাকের নথ’ – গয়না হিশেবে বাঙালি নারীদের অন্যতম পছন্দের একটি উপকরণ হলো নাকের নথের, যার প্রচলন হাজার বছর ধরে। এর আলাদা একটা ঐতিহ্য রয়েছে এখন পর্যন্ত। এটাও জিআই হতে পারে।
• ‘বাঁশের বাঁশি’ – বাঙালিদের সাথে এই বাঁশির সম্পর্কটা অনেক বেশিই গভীর। এর সাথে অনেক আবেগ, অনুভূতি জড়িয়ে থাকে প্রতিটি বাঙালির মনেই। গভীর রাতে হঠাৎ বেজে উঠা বাঁশির শব্দে উদাস হয় নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। যদিও এটা গ্রামের সংস্কৃতি, শহরে এমন হঠাৎ বাঁশির শব্দে উদাস হওয়ার সুযোগ নেই। তারপরও সব ধরনের বাংলা গানের সাথে বাঁশির ব্যবহার হওয়ায় এর শব্দের সাথে সবাই পরিচিত এবং এই শব্দকে ভালো না বেসে উপায় নেই। আমাদের দেশের বাঁশের বাঁশি বাদ্যযন্ত্র হিশেবে অবশ্যই জিআই হতে পারে।
‘শীতলপাটি’ – ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের শীতলপাটির জিআই প্রসেস চলছে। তাই এর গুরুত্ব আলাদা করে বর্ণনা করলাম না।
★ জিআই পণ্যের খুঁজে (নক্সী কাঁথার মাঠ- জসীম উদদীন) পর্ব -৪
কাব্যের এই ৬ষ্ঠ দৃশ্যায়নে বর্ণিত হয়েছে সাজুর জন্য পাগলপ্রায় রুপাই এর সাজুকে এক নজর দেখার আকুলতা, একটু দেখার জন্য বার বার নানান ছল করে সাজুদের বাড়ি যাওয়া, অতঃপর তাদের নিয়ে গ্রামে দুর্নাম ছড়িয়ে পরার কারণে সাজুকে তার মায়ের কড়া শাসন এবং রুপাই কে অপমান, দুজনের দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া আর তাদের অসহনীয় বিরহগাঁথা।
এখানে পাওয়া পণ্যগুলোর কথা লিখছি এখন-
কোনদিন কহে, “খালামা, তোমার জ্বর নাকি হইয়াছে,
ও-বাড়ির ওই কানাই আজিকে বলেছে আমার কাছে।
বাজার হইতে আনিয়াছি তাই আধসেরখানি গজা।”
“বালাই! বালাই! জ্বর হবে কেন? রূপাই, করিলি মজা ;
জ্বর হলে কিরে গজা খায় কেহ?” হেসে কয় তার খালা,
“গজা খায় নাক, যা হোক এখন কিনে ত হইল জ্বালা ;
আচ্ছা না হয় সাজুই খাইবে।” ঠেকে ঠেকে রূপা কহে,
সাজু যে তখন লাজে মরে যায়, মাথা নিচু করে রহে |
‘গজা’– এটা আমাদের অঞ্চলের বেশ জনপ্রিয় একটা মিষ্টি খাবার, গফরগাঁও এ অসংখ্য দোকান আছে যেখান থেকে গরম গরম গজা কিনতে পাওয়া যায়। নাস্তার আইটেম হিশেবে খেতে বেশ লাগে। আমাদের এলাকার বিভিন্ন মিলাদ মাহফিল আর প্রোগ্রামে গজা বিতরণ করতেও দেখেছি আমি। এই মিষ্টি আইটেমের উৎপত্তি কলকাতা আর বাংলাদেশ মিলিয়েই, অর্থাৎ বাঙালিদের হাত ধরেই। তবে অঞ্চল ভেদে গজার আকার আকৃতি আর স্বাদে পার্থক্য আছে। এই কাব্যে গজার কথা এভাবে পাওয়ায় বুঝতে পারছি এটা প্রায় ১০০ বছর আগেও আমাদের এলাকায় একইরকম জনপ্রিয় ছিল। তাই অবশ্যই গজা বিশেষ করে গফরগাঁও এর জিআই হতে পারে।
“কোন দিন কহে, “সাজু কই ওরে, শোনো কিবা মজা, খালা!
আজকের হাটে কুড়ায়ে পেয়েছি দুগাছি পুঁতির মালা ; “
‘পুঁতির মালা’ – এটা আমাদের দেশিয় পুঁতির গয়নার প্রতিনিধিত্ব করছে। সেই ১০০ বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত পুঁতি দিয়ে বিভিন্ন রকমের দেশি গয়না তৈরি হয়ে আসছে। তাই আমাদের দেশি পুঁতির গয়না জিআই হতে পারে।
“মাথার ধামায় এখনও রয়েছে দুজোড়া রেশমী চুরী,
দুপায়ে তাহারে দলিয়া রূপাই ভাঙিয়া করিল গুঁড়ি |”
‘ধামা’– এটা বেতের তৈরি এক ধরনের ঝুড়ি যা দিয়ে শস্য মাপা হয় বা অন্য কোনো জিনিস রাখা হয় বা পরিবহন করা হয়। এ ধরনের ঝুড়ি বর্তমানে শহরের বাসায় সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও ব্যবহার করা হয়। এটা বেত শিল্পের একটা পন্য, যাকে সম্ভাব্য জিআই হিশেবে চিন্তা করাই যায়।
‘রেশমী চুরী’– আমার খুব ভালো লেগেছে প্রায় ১০০ বছর আগের কাব্যে রেশমী চুড়ির কথা পেয়ে। আমি ভাবতাম রেশমী চুড়ি খুব বেশি আগেকার না। আমরা আসলে সবাই এই চুড়ির সাথে পরিচিত এবং সবার প্রিয় চুড়ির তালিকায় এবং সংগ্রহে বিভিন্ন কালারের রেশমী চুড়ি আছেই। খুব ভালো জিআই সম্ভাবনা আছে রেশমী চুড়ির।
কাব্যের এই ৭ম অংশে চিত্রিত হয়েছে গ্রামে রুপাই সাজুর নামে ছড়িয়ে যাওয়া দুর্নাম প্রথম রুপাই এর মায়ের কানে যাওয়া, তারপর সাজুর মায়ের কাছে ঘটক মারফত বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর দৃশ্যপট।
এখানে পাওয়া পণ্যগুলোর কথা লিখছি এখন-
“ও-পাড়ার ও ডাগর ছুঁড়ী, সেখের বাড়ির “সাজু”
তারে নাকি তোর ছেলে সে গড়িয়ে দেছে বাজু |
ঢাকাই শাড়ী কিন্যা দিছে, হাঁসলী দিছে নাকি,
এত করে এখন কেন শাদীর রাখিস বাকি?”
‘বাজু‘- এটাও আমাদের দেশি গয়নার প্রতিনিধিত্ব করছে।
‘ঢাকাই শাড়ি‘- ঢাকাই শাড়ি বলতে ঢাকা অঞ্চলের তাঁতগুলোতে বোনা শাড়ি, যার ঐতিহ্য বহুপ্রাচীন। আমাদের জিআই হওয়া মসলিন এবং জামদানিও এই ঢাকাই শাড়িরই অন্তর্ভুক্ত।
“রূপার মায়ের রুঠা কথায় উঠল বুড়ীর কাশ,
একটু দিলে তামাক পাতা, নিলেন বুড়ী শ্বাস |
এমন সময় ওই গাঁ হতে আসল খেঁদির মাতা,
টুনির ফুপু আসল হাতে ডলতে তামাক পাতা।”
‘তামাক পাতা’– তামাক বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। মূলত এটা নেশা জাতীয় দ্রব্য প্রস্তুতকরণেই ব্যবহার হয়। তবে দেশে ও দেশের বাইরে এর চাহিদা প্রচুর। তাই আমাদের দেশে উৎপাদিত তামাক এবং তামাক জাত পণ্যের জিআই সম্ভাবনা আছে বলা যায়।
“শেখ বাড়িতে যেয়ে ঘটক বেকী-বেড়ার কাছে,
দাঁড়িয়ে বলে, “সাজুর মাগো, একটু কথা আছে |”
সাজুর মায়ে বসতে তারে এনে দিলেন পিঁড়ে,
ডাব্বা হুঁকা লাগিয়ে বলে, “আস্তে টান ধীরে |”
‘পিঁড়ে‘- পিঁড়ি আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। গ্রামের বাড়ি তো এই জিনিস ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত এর চাহিদা রয়েছে। মূলত এটা কাঠ দিয়ে তৈরি হয়। তাই এটা আমাদের কাঠজাত পণ্যেরও পরিচয় বহন করে। ছোট বড় বিভিন্ন আকারের পিঁড়িতে চাইলে বর্তমানে বিভিন্ন ফিউশন এনেও এর চাহিদা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
★ জিআই পণ্যের খুঁজে (নক্সী কাঁথার মাঠ- জসীম উদদীন) -শেষ পর্ব
কাব্যটির ৭ম অধ্যায়ে চিত্রিত হয়েছে রুপাই সাজুর বিয়ের দৃশ্যপট। গ্রামাঞ্চলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, রীতিনীতি, বিয়েতে দুই পক্ষের বাদানুবাদ, মনোমালিন্য, বর-বউ কে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা ইত্যাদির অপূর্ব দৃশ্য কবি তার কবিতার ছন্দে এঁকেছেন এখানে।
“কি কর দুল্যাপের মালো ; বিভাবনায় বসিয়া,
আসত্যাছে বেটির দামান ফুল পাগড়ি উড়ায়া নারে |”
‘পাগড়ি‘- শতবছর আগেও এদেশের বিয়েতে বরের পাগড়ি পরার সংস্কৃতি ছিল এই ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। বিয়েতে বরের পাগড়ির পরার প্রচলন এখন আরও বাড়ছে। একে বাঙালি পোশাক বলা না গেলেও, শত বছর ধরে এটি বাঙালিদের বিয়ের পোশাকের সাথে মিশে আছে একদম।
“আসুক আসুক বেটির দামান কিছু চিন্তা নাইরে,
আমার দরজায় বিছায়া থুইছি কামরাঙা পাটি মারে |
সেই ঘরেতে নাগায়া খুইছি মোমের সস্র বাতি,
বাইর বাড়ি বান্দিয়া থুইছি গজমতি হাতি নারে |”
এই অংশটা হচ্ছে গ্রাম বাংলার বিয়ের একটা মেয়েলি গীতের অংশ বিশেষ যা এই কাব্যে কবি সংযোজন করেছেন। এখানে যে ‘কামরাঙা পাটি’ র কথা উল্লেখ করা হয়েছে সার্চ করে দেখলাম এটা এক ধরনের শীতল পাটি৷ শীতলপাটি খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের জিআই হতে যাচ্ছে।
“কাতার কাতার সৈন্য কাটে যেমন কলার বাগ,
মেষের পালে পড়ছে যেন সুন্দর-বুনো বাঘ !
স্বপ্ন দেখে, জয়গুন বিবি পালঙ্কেতে শুয়ে ;
মেঘের বরণ চুলগুলি তার পড়ছে এসে ভূঁয়ে ;”
‘কলার বাগ’– মানে হলো কলার বাগান। ময়মনসিংহ গীতিকা পড়েও যা বুঝেছি আমাদের অঞ্চলে কয়েকশ বছর ধরে কলার উৎপাদন এবং ব্যবহার বেশ ভালো। নিত্য খাদ্য তালিকায় ফল হিশেবে দেশি কলার চাহিদা সর্বত্র একইরূপ বিদ্যমান প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত। নরসিংদির অমৃত সাগর কলা যেমন সম্ভাব্য জিআই হিশেবে অনেক এগিয়ে, তেমনি ময়মনসিংহের সবরি কলার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়ার মতো না। কারণ আমাদের ময়মনসিংহ গীতিকার মতো শক্ত ঐতিহাসিক দলিলও আছে।
‘পালঙ্ক‘- এটা কয়েকশ বছর ধরে বাংলাদেশের কারুকার্যময় কাঠশিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে। পূর্বের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বেশির ভাগেরই এমন একটা গর্ব করার মতো পালঙ্ক আছে, যা তাদের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক। আমার নানাভাই এর বিশাল একটা কাঠের কারুকার্যময় পালঙ্কে খেলতে খেলতে বড় হয়েছি আমি, এই স্মৃতিটা আমার খুব ভালো লাগার। শশীলজের প্রদর্শনীতে ময়মনসিংহের জমিদারদের ব্যবহৃত কারুকার্যময় খাট এবং অন্যান্য আসবাব রাখা আছে, যা আমাদের কারুকার্যময় কাঠশিল্পের জিআই সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।
“সাজুর মামা খটকা লাগায়, “বিয়ের কিছু গৌণ,
সাদার পাতা আনেনি তাই বেজার সবার মন |”
রূপার মামা লম্ফে দাঁড়ায় দম্ভে চলে বাড়ি ;
সেরেক পাঁচেক সাদার পাতা আনল তাড়াতাড়ি |
কনের খালু উঠিয়া বলে “সিঁদুর হল ঊনা!”
রূপার খালু আনিয়া দিল যা লাগে তার দুনা!”
‘সাদার পাতা’– তামাক পাতাকে এখানে সাদার পাতা বলা হচ্ছে। নক্সী কাঁথার মাঠে তামাকের কথা এসেছে বার বার, কারণ নেশাজাতীয় দ্রব্য হিশেবে আমাদের দেশে এর ব্যবহার অনেক বেশি। আগেও তাই আমি উল্লেখ করেছি এদেশে উৎপাদিত তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যও জিআই হতে পারে।
“মোল্লা তখন কলমা পড়ায় সাক্ষী-উকিল ডাকি,
বিয়ে রূপার হয়ে গেল, ক্ষীর-ভোজনী বাকি!
এয়োরা সব ক্ষীর ছোঁয়ায়ে কনের ঠোঁটের কাছে ;
সে ক্ষীর আবার ধরল যখন রূপার ঠোঁটের পাছে ;
রূপা তখন ফেলল খেয়ে ঠোঁট ছোঁয়া সেই ক্ষীর,
হাসির তুফান উঠল নেড়ে মেয়ের দলের ভীড় |
ভাবল রূপাই—অমন ঠোঁটে যে ক্ষীর গেছে ছুঁয়ে,
দোজখ যাবে না খেয়ে তা ফেলবে যে জন ভূঁয়ে |”
‘ক্ষীর’– গ্রামের বিয়েতে বর বউকে নিয়ে মজা করার বেশ মজার একটা রীতির অংশ হিশেবে ক্ষীরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই মিষ্টিজাতীয় রান্নার আইটেম বাঙালির কয়েকশো বছরের ঐতিহ্য। খাবার হিশেবে তাই এটার জিআই হওয়ার দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।
কাব্যের এই নবম পর্বে বর্ণিত হয়েছে রুপাই সাজুর বিয়ের কিছুদিন পরই রুপাই এর মায়ের মৃত্যু এবং শোকাচ্ছন্ন নবদম্পতির নতুন করে নিজেদের সংসার সাজানোর দৃশ্যপট।
“ঘামলে পরে যে তাহারে করত আবের পাখা ;
সেই শাশুড়ী মরে, সাজুর সব হইল ফাঁকা |”
‘আবের পাখা’– ময়মনসিংহ গীতিকায়ও অসংখ্যবার পেয়েছি আবের পাখা আর আবের কাঁকই বা চিরুনীর কথা। বেশ কৌতুহল বোধ করছিলাম তাই এটা নিয়ে। তবে আবের জিনিসটা আসলেই কী এটা নিয়ে কনফিউশান আমার এখনো যায় নি। গীতিকার ফুটনোটে আবের শব্দের অর্থ লিখেছে অভ্র, যা এক ধরনের অধাতব খনিজ পদার্থ, যাকে মাইকাও বলা হয়। এতে সিলিকার পরিমাণ বেশি থাকায় এটা বহুল ব্যবহৃত একটা প্রাকৃতিক উপাদান, যা দিয়ে কসমেটিক্স, ইলেকট্রনিক সামগ্রী ছাড়াও বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা হয়। তবে পূর্বের সাহিত্যে এর এতো বহুল ব্যবহারের রহস্যটা উদ্ধার করতে পারিনি আমি।
কাব্যের এই ১০ম অংশে নতুন কিষাণ-কৃষাণীর সংসার, ধান মাড়াই কাজের মধুর ব্যস্ততার দৃশ্যপট অঙ্কিত হয়েছে।
“দাবায় শুইয়া কৃষাণ ঘুমায়, কৃষাণীর কাজ ভারি,
ঢেকির পারেতে মুখর করিছে একেলা সারাটি বাড়ি।”
‘ঢেকি’– ঢেঁকি আমাদের গ্রাম বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য, এটা একান্তই আমাদের দেশের নিজস্ব। গ্রামের কৃষক পরিবার ঢেঁকি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। ঢেঁকির বিকল্প এখন আধুনিক মেশিনের ব্যবহার হলেও ঢেঁকি ছাটা চালের কদর কমেনি এবং এটা একটা স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি।
কাব্যের ১১তম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে জমি দখল নিয়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত দাঙ্গা হাঙ্গামার, যাতে রুপাই নেতৃত্ব দেয় এবং অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। রুপাই মামলায় জড়িয়ে যাওয়ায়, তাকে পালিয়ে যেতে হয় এবং সাজুর সাথে তার দীর্ঘ বিচ্ছেদের সূচনা হয় এখান থেকেই। রাতের আঁধারে সাজুর থেকে বিদায় নিয়ে রুপাই এর পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য থেকে কাব্যের বাকি অংশ বিরহের এবং মনে দাগ কাটার মতো। এই অংশে তেমন কোনো পণ্যের নাম আমার চোখে পরে নি আলাদা করে।
বারো-
“ঘরের মেঝেতে সপটি ফেলায়ে বিছায়ে নক্সী-কাঁথা,
সেলাই করিতে বসিল যে সাজু একটু নোয়ায়ে মাথা।”
“নক্সী-কাঁথায় আঁকিল যে সাজু অনেক নক্সী-ফুল,
প্রথমে যেদিন রূপারে সে দেখে, সে খুশির সমতুল |
আঁকিল তাদের বিয়ের বাসর, আঁকিল রূপার বাড়ি,
এমন সময় বাহিরে কে দেখে আসিতেছে তাড়াতাড়ি |”
‘সপটি‘- সপটি মানে খুঁজে পেলাম পাটি বা বড় মাদুর। শীতলপাটি ছাড়াও আমাদের দেশে পাটির অনেক ধরন আছে, যেমন- খেজুর পাতার পাটি, হোগলার পাটি, মুর্তা পাতার পাটি, বেত, বাঁশের পাটি, নকশী পাটি ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিটিই আলাদা আলাদা জিআই হতে পারে।
‘নক্সীকাঁথা’– কাব্যের নামের এবং মূলকাহিনী এর সাথে সম্পর্কিত থাকায় এই কাব্যে অসংখ্য বার নকশিকাঁথার কথা এসেছে। আমাদের দেশে নকশি কাঁথার ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। অঞ্চল ভেদে আবার এর মোটিফ, সেলাই, ডিজাইন ইত্যাদিতে অনেক পার্থক্য রয়েছে। তাই প্রত্যেকটা অঞ্চলের নকশিকাঁথা আলাদা জিআই হতে পারে।
কাব্যটির ১৩তম অংশে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে পলাতক রুপাই এর জন্য অপেক্ষমান সাজুর বিরহ এবং নকশিকাঁথার ফোড়ে ফোড়ে তাদের প্রেম, ঘর-সংসার, বিরহ এবং মৃত্যু পূর্বেই মৃত্যু পরবর্তী কাহিনী অঙ্কনের মাধ্যমে সাজুর মৃত্যুর এক করুণ গাঁথা বর্ণিত হয়েছে।
“কাহার গাছের জালি কুমড়া সে ছিঁড়েছিল নিজ হাতে,
তাহারি ছোঁয়া কি লাগিয়াছে আজ তার জীবনের পাতে!”
‘জালি কুমড়া’– কাব্যের শুরুতে কবি একবার উপমার্থে জালি লাউ এর কথা উল্লেখ করেছেন রুপাই এর বর্ণনা দিতে গিয়ে। আমি যতটুকু বুঝতে পারলাম, জালি লাউ আর জালি কুমড়া একই জিনিস। একে আমাদের স্থানীয় জাতের কুমড়া বলতে পারি৷ এখনো এর চাষ হয়। জালি লাউ এর থেকে জালি কুমড়া নামই বেশি ব্যবহৃত হয় বলে দেখছি।
“ভাদ্র মাসেতে পাটের বেপারে কেউ কেউ যায় গাঁরষ
নানা দেশে তারা নাও বেয়ে যায় পদ্মানদীর পার |”
‘পাট‘- আগেও একবার লিখেছি পাটের জিআই সম্ভাবনার কথা৷
কাব্যের ১৪তম এবং শেষ অংশে রুপাই সাজুর গল্পের ইতি টেনেছেন কবি রুপাই এর ফিরে আসা এবং সাজুর নকশি কাঁথার শেষ দৃশ্য সত্য হওয়া অর্থাৎ সাজুর জন্য রুপাই এর বিরহ এবং সাজুর কবরের পাশে বাঁশি বাজাতে বাজাতে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার বর্ণনার মাধ্যমে। এই অংশে আলাদা করে লেখার মতো কোনো পণ্যের নাম চোখে পরেনি।
(সমাপ্ত)