
এয়ারলাইন্সের যাত্রীদের মাঝে বাড়ছে ইনফ্লাইট ওয়াইফাই ব্যবহারের জনপ্রিয়তা। দীর্ঘ আকাশ যাত্রায় কোম্পানিগুলো যাত্রীদেরকে ফ্রি মেসেজিং এর জন্য ওয়াইফাই সুবিধা দেয়। তবে ইন্টারনেটের অন্যান্য ব্যবহার যেমনঃ নেটফ্লিক্স বা এইচবিও তে মুভি দেখা, ব্রাউজিং করা ইত্যাদির জন্য ওয়াইফাই ব্যবহার করতে হলে তাদেরকে পে করতে হয়৷
মেসেজিং ছাড়া অন্যান্য ইন্টারনেট ইউজের জন্য প্রায় সব এয়ারলাইন্সই যাত্রীদের প্রিমিয়াম ওয়াইফাই সার্ভিস দেয়। ডেলটা এয়ারলাইন্স ইউএস ফ্লাইটের ওয়াইফাই ইউজের জন্য যাত্রীদের থেকে ৫০ ডলার মাসিক ফি নেয়। এখন তারা প্রতি ফ্লাইটে প্রতি ডিভাইসের ইউজের জন্য ৫ ডলার করে চার্জ করার প্ল্যান করছে।
বর্তমানে এই ইনফ্লাইট ওয়াইফাইকে কেন্দ্র করে ৫ বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি হয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে ২০৩০ সালে এটি ১২ বিলিয়ন ডলারের বাজারে পরিণত হবে।
সিএনএনকে দেয়া তথ্য অনুযায়ী,
- ডেলটা এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স প্রত্যেকেই প্রতি মাসে ১.৫ মিলিয়ন ইনফ্লাইট ওয়াইফাই সেশন হোস্ট করে থাকে।
- জেটব্লু জানায়, প্রতি বছর তাদের মিলিয়ন যাত্রী ওয়াইফাই সার্ভিস নিয়ে থাকে।
- সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্স কোনো স্পেসিফিক সংখ্যার উল্লেখ না করলেও জানায়, তাদের যাত্রীদের মাঝেও ইনফ্লাইট ওয়াইফাই খুব জনপ্রিয়।
- আলাস্কা এয়ারলাইন্স জানায়, গড়ে তাদের ৩৫% যাত্রী ৮ ডলার ($) মূল্যের ওয়াইফাই সার্ভিসটি নিয়ে থাকে ওয়েব ব্রাউজিং এবং স্ট্রিমিং এর জন্য।
প্রায় দুই দশক ধরে ইনফ্লাইট ওয়াইফাই চালু হয়েছে। বিমান নির্মান প্রতিষ্ঠান বোয়িং প্রথম ২০০০ সালে এই সেবা চালু করার ঘোষণা দেয় এবং ২০০৪ সাল থেকে এই সেবা চালু করতে সক্ষম হয় তারা। তবে ২০০৬ সালে বোয়িং ইনফ্লাইট ওয়াইফাই সেবা বন্ধ করে দেয় প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা পায় নি বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে স্মার্টফোনের আবির্ভাব এবং স্যাটেলাইট প্রোভাইডারদের সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি বেড়েছে, যদিও বাসায় বা অফিসে ব্যবহৃত ওয়াইফাই এর মতো ভালো স্পিড এখনো ইনফ্লাইট ওয়াইফাই দিয়ে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷
এটি কীভাবে কাজ করে?
দুই ধরণের ইনফ্লাইট ওয়াইফাই কানেকশন রয়েছে।
- ATG or Air-to-Ground:
এর মাধ্যমে সংযুক্ত এয়ারক্রাফটে এন্টেনা থাকে যা গ্রাউন্ডে থাকা মোবাইল ফোন টাওয়ার থেকে সিগন্যাল গ্রহন করে এবং যাত্রীদের ডিভাইসে ওয়াইফাই সুবিধা দেয়।
ইন্টেলস্যাট আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর সাথে মিলে ২০০৮ সালে এই Air-to-Ground সার্ভিস চালু করেছিল এবং বর্তমানে এটি নর্থ আমেরিকার ১হাজারের বেশি এয়ারক্রাফটে এই প্রযুক্তি সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
এই প্রযুক্তির বিশেষ ত্রুটি রয়েছে। সেলফোন টাওয়ারের উপর নির্ভরশীল থাকার এর কানেকশন এবং স্পিড নির্ভর করে টাওয়ারের ঘনত্ব এবং সংখ্যার উপর। তাই দুর্গম অঞ্চল, মরুভূমি, বা সমুদ্রের উপর দিয়ে বিমান অতিক্রম করে সময় কানেকশন অনেক বেশি দুর্বল হয়ে যায়।
এবিআই রিসার্চ ফার্মের প্রযুক্তিবিদ এবং রিসার্চ ডিরেক্টর এন্ডু জিগনানির মতে, এই সিস্টেমের মাধ্যমে ফ্লাইটে সর্বোচ্চ প্রতি সেকেন্ডে ৫ মেগাবাইট স্পিড পায়, যা আবার ফ্লাইটের সব যাত্রীদের ডিভাইসে ভাগ হয়ে যায়।
আর স্বাভাবিক ভাবে গ্রাউন্ডের মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড এর ওয়াইফাই এর মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে যথাক্রমে ৩০ মেগাবাইট এবং ৬৭ মেগাবাইট স্পিড পেয়ে থাকে, যা বিশাল পার্থক্য তৈরি করে ইনফ্লাইট ওয়াইফাই সংযোগের সাথে।
সিএনএনকে জিগনানি বলেন, এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তির বড় সমস্যাগুলো হলো এর স্পিড, অপর্যাপ্ততা, কভারেজ গ্যাপ, বিচ্ছিন্ন সংযোগ এবং প্রাইস।
- Satellite-based Connection:
টাওয়ার এবং এন্টেনা বেইজড সংযোগের ত্রুটির কারণে এখন এয়ারলাইন্সগুলো স্যাটেলাইট বেইজড ওয়াইফাই সংযোগের দিকে ঝুঁকছে। স্যাটেলাইট স্পেস থেকে ফ্লাইটের পুরো পথটাকেই কভার করতে পারে এবং সব সময় সিগন্যালকে এক্টিভ রাখতে পারে।
ইন্টেলস্যাটের ৫০টির বেশি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক রয়েছে যা আলাস্কা, আমেরিকান, ডেল্টা, ইউনাইটেড, এয়ার কানাডা, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ এবং ক্যাথি প্যাসিফিক এয়ারলাইন্সগুলোকে ইন্টারনেট সুবিধা দিচ্ছে।
বিশ্বের প্রধান কয়েকটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক প্রোভাইডারদের মাঝে অন্যতম হলো Viasat, যা তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে উচ্চগতি সম্পন্ন ইনফ্লাইট ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। তারা এই বছরের শেষের দিকে আরও একটি স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কোম্পানিটি ২০১৩ সালে জেটব্লু কে সার্ভিস দেয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল এবং বর্তমানে এটি বিশ্বের ডজনেরও বেশি এয়ারলাইন্সকে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
তবে স্যাটেলাইট বেইজড সংযোগগুলিও বর্তমানে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মেগাবাইট স্পিডের বেশি দিতে সক্ষম নয়, যা থেকে যাত্রীরা ডিভাইস প্রতি মাত্র ১৫ মেগাবাইট প্রতি সেকেন্ড স্পিড পায়। এটি গ্রাউন্ডে পাওয়া ইন্টারনেট স্পিড থেকে অনেক কম।
এই সেক্টরে নতুন খেলোয়াড় হিশেবে প্রবেশ করেছে এখন ইলন মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার স্টারলিঙ্ক। এই বছরের শুরুর দিকে স্পেসএক্স হাওয়াইন এয়ারলাইন্সের সাথে পার্টনারশিপ ঘোষণা করেছে এবং হাই-স্পিড ইন্টারনেট সেবা স্টারলিঙ্ক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে একে সরবরাহ করতে শুরু করেছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ
ইনফ্লাইট ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের সাথে স্থলভাগের যে কোনো জায়গায় ব্যবহৃত ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের এখনো বিশাল গ্যাপ রয়েছে। ইতিমধ্যে যদিও এয়ারলাইন্সগুলো মেসেজিং, সোসাল মিডিয়া লগ ইন, ব্রাউজিং এবং স্ট্রিমিং সুবিধা দিচ্ছে, তারপরও তা পর্যাপ্ত নয়, সীমিত।
ইনফ্লাইট ওয়াইফাই এর চাহিদা যেভাবে বাড়ছে সেই অনুযায়ী কভারেজ এবং স্পিড বাড়ানো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে চাহিদা অনুযায়ী স্যাটেলাইট বেইজড সংযোগ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করা টাওয়ার স্থাপনের চেয়ে অনেক গুন বেশি ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। টাওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাবে অনেক দ্রুত এবং কম খরচে। তাই এদিকটায়ও কাজ করতে হবে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক সরবরাহকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ৬৫% রেসপন্ডেন্ট বলেছেন, ফ্লাইটের যাত্রীরা অধিকাংশই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ প্রত্যাশা করে এবং এক্ষেত্রে দুটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলোগ ইনফ্লাইট ওয়াইফাই সার্ভিসের উচ্চ মূল্য ও দুর্বল স্পিডের ইন্টারনেট সংযোগ।
Viasat, Intelsat এবং Starlink – এর মতো কোম্পানিগুলো কাজ করে যাচ্ছে এই সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য এবং আরও ভালো ইনফ্লাইট ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়ার জন্য। ক্রমবর্ধমান চাহিদা অনুযায়ী প্রতি বছর আরও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করছে তারা। এই ধরণের সক্ষমতা যত বাড়বে এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদেরকে তত ভালো স্পিডের ইন্টারনেট সার্ভিস দিতে পারবে।
এয়ারলাইন্সগুলো এখন এড স্পন্সরড ইনফ্লাইট ওয়াইফাই সংযোগের চিন্তাও করছে যেন, যাত্রীদেরকে ফ্রি ওয়াইফাই সুবিধা এর মাধ্যমে দেয়া যায়। এদিকে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যকার পার্টনারশিপ খুব কাজে দিবে।
ইন্টারস্যাট এয়ারলাইন্স এর ভিশন হলো, যাত্রীদেরকে এমন ইন্টারনেট সুবিধা দেয়া যার মাধ্যমে যাত্রীরা স্থলভাগের ইন্টারনেটের সাথে ইনফ্লাইট ইন্টারনেটের কোনো পার্থক্যই করতে পারবে না।
সোর্স লিঙ্কঃ
https://www.google.com/amp/s/amp.cnn.com/cnn/2022/09/03/tech/inflight-wifi-technology/index.html
লেখকঃ
খাতুনে জান্নাত আশা,
রিসার্চার, দেশি পণ্য ই-কমার্স