কিশোর ক্লাসিক- ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক – আলেকজান্ডার দ্যুমা বুক সামারি & রিভিউ by খাতুনে জান্নাত আশা - September 14, 20210 Spread the lovemoreকিশোর ক্লাসিক- ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক আলেকজান্ডার দ্যুমা “ম্যান ইন দ্যা আয়রন মাস্ক” আলেকজান্ডার দ্যুমা’র “থ্রী মাস্কেটিয়ার্স” এর সিক্যুয়াল। এই কিশোর ক্লাসিক গল্পটিতে আমরা এক ভাগ্য বিড়ম্বিত রাজপুত্রের দেখা পাব, যার জন্য আপনার কঠিন হৃদয়ও কেঁদে উঠবে, ভেতরটা অদ্ভুত এক শূন্যতায় ছেয়ে যাবে। তবে শুরু করা যাক। আমার আগের পোস্টে “থ্রী মাস্কেটিয়ার্স” এর রিভিউ যারা পড়েছেন তারা অবশ্যই দারতানিয়াকে চিনে থাকবেন। মার্শাল দ্যা ত্রেভিয়ের মৃত্যুর পর উনার জায়গায় রাজার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ক্যাপ্টেন হিসেবে স্থান পেয়েছেন এখন দারতানিয়া। এতেও কিন্তু এখনও সে সন্তুষ্ট না, কারণ তার স্বপ্ন সে একদিন ফ্রান্সের মার্শাল হবে, যোগ্যতা দেখিয়ে জিতে “ফ্লেয়ার দ্যা লি” আঁকা মার্শালের ব্যাটন। তার প্রিয় সহযোদ্ধা, প্রিয় বন্ধু ৩ মাস্কেটিয়ার্স অবসর নিয়েছেন অনেক বছর আগেই, দারতায়া এখন বড় একা অনুভব করে নিজেকে, বয়স হইয়েছে। যুবক থেকে এখন সে প্রৌড়। প্রায়ই আগের স্মৃতিগুলো স্মরণ করে আনমনেই হেসে ফেলে সে, কতই না উত্তেজনাপূর্ন আর রোমাঞ্চকর ছিল আগের সেই দিনগুলো। মনে পরে ৪ বন্ধুর একসাথে করা সেই শপথের কথা, “সবাই একজনের জন্য, একজন সবার জন্য”। রাজা ত্রয়োদশ লুই, প্রধানমন্ত্রী কার্ডেনাল রিশেলিও আর বেঁচে নেই। নতুন রাজা এখন চতুর্দশ লুই, ত্রয়োদশ লুই এর একমাত্র ছেলে। এক মাস্কেটিয়ার্স আথোস অবসর নিয়ে তার গ্রামে গিয়ে নিজের পূর্ব পরিচয় “কাউন্ট দ্যা লা ফেয়ার” হিসেবে নিজের জমিদারিতে বসেছিল। তার ছেলে রানীমা অস্ট্রিয়ার প্রিয়ভাজন এক সুন্দরী সেবিকার প্রেমে পরে যায়। এদিকে রাজা ওই মেয়েকে গোপনে পছন্দ করে বসে আছে কিন্তু কাউকে বলেনি। রাজা যখন জানতে পারল আথোসের ছেলে এই মেয়েটা কে বিয়ে করতে যাচ্ছে। তখনই রাজা এই বিয়ে আটকে রাখার জন্য আথোসের ছেলেকে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেয়। আথোস অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। দারতায়া হয়ত এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতে পারত, কিন্তু সে রাজার মাস্কেটিয়ার্স, রাজার সম্মানকে প্রান দিয়ে হলেও রক্ষা করবে এই শপথ নিয়েই তো এ পদে এসেছে সে। তাই এ শপথ ভেঙে কিছু করতে পারবেনা সে। আরেকজন পার্থোস , সে হতে চায় ডিউক। ডিউক হওয়ার জন্য যে কোনো ঝুঁকি নিতে সে প্রস্তুত। আর আরামিস শান্তির খুঁজে নিয়েছিল ধর্মের আশ্রয়। সে এখন একজন বিশপ, আর অর্থমন্ত্রী ফোকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অর্থমন্ত্রী ফোকে কে আবার রাজা একদম পছন্দ করে না, সুযোগ পেলেই ফোকে কে ঝুলিয়ে দিবে। কারন জনপ্রিয়তা আর আভিজাত্যে ফোকে রাজাকেও হার মানায়। ফোকে প্রচুর টাকা উড়ায়, সবার ধারনা এগুলো রাজকোষেরই টাকা সব সে নিজের জন্য খরচ করে। রাজা হঠাত একদিন ফোকের কাছে ১৩ লক্ষ ফ্রা চেয়ে বসে, কিন্তু রাজকোষে কোনো টাকাই নেই তখন, ওর সুন্দরী বান্ধবী এটা শুনে ওর যত গহনা ছিল সব ফোকে দেয় বিক্রি করে রাজাকে টাকা দেয়ার জন্য, অপারগ হয়ে ফোকে তাই করে। কিন্তু মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায় মেয়েলোকের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস এই গয়না বিক্রি করতে। যার কাছে বিক্রি করেছে তাকে গয়নাগুলো কিছুদিনের জন্য রেখে দিতে বলে, আবার এগুলো ছাড়িয়ে নিবে বলে। আর সারাদিনরাত এই টাকা যোগাড় করবে কিভাবে ভাবতে থাকে। ফোকে অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি একজন প্রোকিউরার জেনারেল ছিল, একদিন এক লোক আসে তার এই চাকরির পদটা ১৪ লক্ষ ফ্রার বিনিময়ে কিনতে চায়। তখন ফ্রান্সে সরকারি চাকরিগুলোর পদ কেনাবেচা হতো এভাবেই!! ফোকে অনেক ভাবনা চিন্তার পর রাজি হয়ে গেল বান্ধবীর গয়নাগুলো ফিরিয়ে আনতে পারার কথা ভেবে, এই মুহূর্তে এটাই তার সবচেয়ে জ্রুরী বলে মনে হলো। ওইদিকে যে ওর শত্রুরা ওকে পুরোপুরি কোণঠাসা করার জন্য, নিঃস করে দেয়ার জন্য এমন প্ল্যান করেছে, এটা আর সে বুঝতে পারেনা। সে ওর চাকরির পদ বিক্রি করে যথারীতি টাকা দিয়ে গয়নাগুলো এনে বান্ধবীকে দিয়ে শান্তি পায়, বান্ধবীও ভীষন খুশি হয়। এই আনন্দে ফোকে সব বন্ধুদের নিয়ে আবার পার্টির আয়োজন করে। আর তখনই পার্টির মাঝেই বেচারা ফোকে কে এসে দুঃসংবাদ দেয় আরামিস যে, আগের প্রধানমন্ত্রী মৃত্যুর আগে ফোকের নামে এক অভিযোগ করে রেখে যায় যে, ফোকে রাজকোষের ১ কোটি ফ্রা আত্মস্বাত করেছে, এর জন্য ওর মন্ত্রীত্ব কেড়ে নিয়ে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ফোকে বলে সে এক কোটি ফ্রা নেয় নি, প্রধানমন্ত্রীকে সেই টাকা দিয়েছিল। সেটার রিসিটও আছে তার কাছে। কিন্তু কাগজপত্র সব তন্নতন্ন করে খুজেও রিসিট পায়না কোথাও,তারমানে সে টাও চুরি করা হয়েছ। ফোকে এইবার কিছুটা হলেও ঘাবড়ে যায়। কিন্তু আরামিস ওকে বুদ্ধি দেয় এক বিশাল জমকালো অনুষ্ঠান করে রাজাকে তার বাড়িতে দাওয়াত করে আনার জন্য। তাহলে রাজা খুশি হয়ে যাবে, আর ওর মন্ত্রী পদ বহাল থাকবে। অনুষ্ঠানের সব তদারকি আরামিস করবে বলল। ফোকে সেই প্ল্যান অনুযায়ী রাজাকে দাওয়াত দিয়ে এলো, রাজা দাওয়াত গ্রহণ করলেন। এদিকে আথোস এলো রাজার সাথে দেখা করতে। রাজা যদিও আথোসের আগমনে খুব খুশি হলেন না। কিন্তু ওর প্রয়াত বাবার এই বিশ্বস্ত মাস্কেটিয়ার্সের সাথে অন্তত মুখে হলেও ভালো ব্যবহার করতে হবে তাকে। আগেই লিখেছি যে, আথোসের ছেলে আর রাজা একি মেয়েকে ভালোবাসে বলেই রাজা ওকে ইংল্যন্ড পাঠিয়ে দিয়েছিল, এই ব্যাপারেই যে আথোস কথা বলতে এসেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই রাজা অনেক কষ্টে নিজের অস্থিরতা দমন করে আথোসকে অভিবাদন করল। আথোস অভিযোগ করল যে, রাজা যে ওই মেয়েকে ভালোবাসেন এটা প্রকাশ না করে কেনো তার ছেলেকে নির্বাসিত করা হল? কেনো দুইটা মানুষের জীবন নষ্ট করা হল। আথোস এবং তার ছেলের রাজার প্রতি আনুগত্যের কি এটাই পুরষ্কার? রাজা ভীষন রেগে গেল ওর কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হচ্ছে বলে। অনেক তর্ক বিতর্ক এবং উত্তেজনা আর রাজাকে অনেক কথা শোনানোর পর আথোস বেরিয়ে গেল, রাজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে দারতানিয়া কে খবর পাঠালেন আথোস কে গ্রেফতার করে কারাগারে বন্দি করার জন্য। দারতানিয়া খুব বিস্ময় নিয়ে রাজার আদেশ পালন করতে বন্ধু আথোসের বাসায় গেলেন ওকে গ্রেফতার করার জন্য। দারতানিয়া কে দেখেই আথোস বুঝলো ওকে গ্রেফতার করতে এসেছে। আথোস নিজেই বলল বন্ধুকে, “চলো তাহলে যাই আমরা। তোমাকে দেরী করিয়ে দিতে চাইনা” দারতায়া জিজ্ঞেস করল, “আমি তোমার সামনে থাকব নাকি পেছনে?” আথোস বলল, দুটোর একটাও না, আমরা চিরদিন যেভাবে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছি আজো ঠিক এভাবেই হেঁটে যাব। দারতায়া ওকে বলল, আথোস চাইলেই যে কোনো জায়গায় থেকে চলে যেতে পারে, এজন্যই সে নিজে বন্ধুকে গ্রেফতার করতে এসেছে। যেদিকে ইচ্ছে হয় গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারে, পালানোর সব ব্যবস্থাই সে আথোসকে করে দিবে, সে সীমান্ত পার না হওয়া পর্যন্ত রাজার কাছে ফিরে যাবে না। একবার সীমান্ত পেরিয়ে গেলে রাজার আর কিছু করার থাকবে না। কিন্তু আথোস ওর বন্ধুর এই দারুণ প্রস্তাবে রাজি হলো না, নীতিতে অটল রইল। আর বলল, “তুমি যদি আমাকে কারাগারে নিয়ে যেতে না চাও, ছেড়ে দাও। নিজেই আমি কারাগারে গিয়ে উঠব। দারতানিয়াত অবাক হয়নি বন্ধুর কথায়, কারন সে জানত আথোস তার নীতিতে কতোটা অটল। দুই বন্ধু গেল কারাগারে, সেখানে গিয়ে কারাগারের গভর্নরের অফিসে আরেক বন্ধু আরামিসকে পেল। দারতানিয়া আথোস কে সাবধান করল সে যে বন্দি হয়ে এসেছে এখানে এটা যেন আরামিস বুঝতে না পারে। বোঝাল ওরা সবাই গভর্নরের সাথে আড্ডা দিতে এসেছে। আথোস কে এখানে আড্ডা দিতে রেখে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে গেল দারতানিয়া। সোজা সে রাজার কাছে গিয়ে হাজির হলো। রাজা আথোসের ব্যাপারে জানতে চাইল দারতানিয়ার কাছে। দারতায়া বলল, গ্রেফতার যে হতে হবে তা আথোস আগেই জানত। রাজা- আচ্ছা, তার মানে কি ,ওর বিদ্রোহী ভাবটা এখনও যায় নি? দারতায়া- বিদ্রোহী ভাব? বিদ্রোহী ভাব বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন জানিনা, মহানুভব। লোকটা স্বেচ্ছায় বাস্তিলে ঢুকেছে। আমি ওকে ছেড়ে দিতে চাওয়ার পরও সে পালাতে চায় নি, নিজে গিয়ে কারাগারে ঢুকেছে। এটাকেই কি আপনি বিদ্রোহী ভাব বলছেন? রাজা- মানে ক্যাপ্টেন, আপনিই ওকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন আমার আদেশ সত্ত্বেও ? আপনি রাজার আদেশ অমান্য করেছেন? রাজা প্রচন্ড রেগে বলল, আমার ধৈর্য অসীম নয় ক্যাপ্টেন। আপনিও কি বন্দি হতে চান? দারতায়া- হ্যাঁ মহানুভব, কারাগারে আমার বন্ধু একা তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে!! আমি তাই আপনার অনুমতি নিতে এসেছি , আমিও নিজেকে কারাগারে বন্দি করে নিয়ে যেতে চাই। রাজা কাগজ কলম টেনে নিল গ্রেফতারি পরোয়ানা লেখার জন্য আর বলল, ক্যাপ্টেন আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই, যে একবার এই কারাগারে ঢুকে সে আর কখনো ফিরে আসে না। দারতায়া- জানি মহানুভব, আর এও জানি এমন একটা হুকুম দেয়ার পর আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারবেন না আপনি। কাগজ কলম ছুড়ে ফেলে দিলেন রাজা, মসিয়ে দারতানিয়া!!! আপনিও কি আপনার বন্ধুর মতো রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চাইছেন?! দারতায়া- না মহানুভব, বিদ্রোহ করতে চাইলে আর আসতাম না, বন্ধুকে নিয়ে পালাতাম। প্রথমত আমার বন্ধু বিদ্রোহ করেনি, করবেও না। সে যা করেছে তাকে যদি বিদ্রোহ বলেন তাহলে আমি রাজা হলে নিশ্চয় সমর্থন করতাম। শুধু সমর্থন না, সদয়ভাবে কথা বলতাম আমার অনুগত প্রজার সাথে। মানুষের চোখে তাকাতাম তার দিকে। বলতাম- মসিয়ে কাউন্ট, আমার অন্যায় হয়েছে, আমি যে রাজা তা ভুলে গিয়েছিলাম। একজন ভদ্রলোক কে অপমান করার জন্য সিংহাসন ছেড়ে নেমে এসেছিলাম অনেক নীচে। রাজা- ক্যাপ্টেন, আপনি ভেবেছেন আপনার বন্ধুর চেয়ে উদ্ধত আচরন করে মুক্ত করে আনবেন উনাকে? দারতায়া- নিশ্চয়, উদ্ধত আচরণ করা ছাড়া আর উপায় কি? এজন্য কাউকে যদি দায়ী করতে হয় সে তো আপনি। আমার বন্ধু আর কি বলেছে ,তার থেকে অনেক বেশি আমি বলব। নিশ্চয় বলব! বলব যে, আপনি ওর ছেলের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন। ও প্রতিকার চাইতে এসেছিল, প্রতিকার তো পেলোই না,উলটো তার জীবনকেও ধ্বংস করে দিলেন আপনি, চিরদিনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন কারাগারে! আপনি আসলে আপনার চারপাশে কাদেরকে চান মহানুভব? সাহসী বন্ধু নাকি মেরুদন্ডহীন ভৃত্য? সৈনিক নাকি কৃতদাস? মানুষ নাকি খেলার পুতুল, কি চান আপনি? আপনি কি চান আপনার চারপাশে শেয়াল কুকুরের দল ঘোরাফেরা করবে? বেশ, তাই যদি হয় তবে আমাকেও কারাগারেই পাঠিয়ে দিন। আপনার মতো রাজার অনুচর হওয়ার চেয়ে কারাগারে কাটানো ভালো। মহানুভব, সত্যি কথা শোনার সৎসাহস যদি না থাকে তাহলে আপনি ভালো রাজা হবেন কি করে? আর যদি ভালো রাজা না হতে পারেন তাহলে দুর্ভাগ্য কখনো আপনার পিছু ছাড়বেনা। কোনো এক সুন্দর সকালে উঠে দেখবেন আপনি আর রাজা নেই। কোনো দিন ভাবিনি আমার রাজাকে এ ধরনের কথা শোনাতে হবে, আপনি বাধ্য করলেন বলেই বলতে হলো। রাজা তিক্ত এই কথাগুলো আর সহ্য করতে না পেরে টলতে টলতে একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে গেলেন। মাথায় ব্জ্রাঘাত হলেও বুঝি এতো চমকাতেন না, একবারে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে তার হৃদয়। কয়েক্মুহূর্ত চুপ থেকে দারতায়া নিজের খাপ থেকে তলোয়ার খুলে রাজার সামনে টেবিলে রাখলেন। সাথে সাথে রাজা সেটাকে ঠেলে ফেলে দিল। এবার সহ্য করতে পারল না দারতায়া। রাগে পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, “ ইচ্ছে করলে সৈনিককে তাড়িয়ে দিতে পারেন, বরখাস্ত করতে পারেন, প্রাণদণ্ডও দিতে পারেন। কিন্তু সৈনিকের তলোয়ার ছুড়ে ফেলে দিয়ে তাকে অপমান করার অধিকার কোনো রাজার নেই। মহানুভব, আমি যদি সৈনিক হই ,এই কলঙ্কিত তলোয়ার আর খাপে পুরতে পারব না। এখন এর উপযুক্ত খাপ হয় আপনার বুক , না হয় আমার বুক। আমি আমার বুকই বেছে নিলাম।“ হঠাত কি যে হলো রাজার ভেতর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন । ছুটে গিয়ে ডান হাতে জড়িয়ে ধরলেন দারতায়ার গলা আর বা হাতে তলোয়ার। আস্তে আস্তে সেটা খাপের ভেতর পুরে দিলেন। নিঃশব্দে টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে আথোসকে মুক্তি দেয়ার আদেশ নামা লিখে দিলেন। যান, ছেড়ে দিন গে আপনার বন্ধুকে। খুশিতে লাফিয়ে উঠল দারতানিয়া, রাজার এক হাত টেনে নিয়ে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, মুক্ত করে দিল বন্ধুকে। এদিকে বন্ধু আরামিস এক ভয়ংকর ফন্দি আঁটছে। সে ভয়ংকর কারাগারে এক কয়েদির সাথে দেখা করতে গেল কারাগারের পাদ্রী সেজে। সেই কয়েদি আর কেউ নয় রাজা ত্রয়োদশ লুই এর আরেক পুত্র,বর্তমান রাজা চতুর্দশ লুই এর জমজ ভাই ফিলিপ। এই হতভাগা রাজপুত্র জন্মের পর থেকেই বন্দি, জন্মানোটাই যেন ছিল তার সবচেয়ে বড় অপরাধ। শুনতে চান সেই কাহিনী?! রানী অস্ট্রিয়া একজন ছেলে সন্তান জন্ম দেয়ার পর রাজা, রাজসভায় আনন্দের হিরিক পরেছিল, রাজা সেই উপলক্ষ্যে আয়োজন করলেন বিশাল ভোজসভার। এদিকে কিছু সময় পর আবার খবর এলো রানী দ্বিতীয় পুত্রের জন্মদান করেছেন। রাজা তো খুশিতে ছুটে এলো। কি সৌভাগ্য তার একসাথে দুই পুত্র পেয়ে গেল। কিন্তু তখনকার প্রধানমন্ত্রী বললেন অদ্ভুত কথা। এক রাজ্যের রাজা একজনই হয় আর রাজার উত্তরাধিকার একের অধিক হওয়া মানেই এখানে নিজেদের মাঝে যুদ্ধ বিগ্রহ। তাই বড় ছেলে অর্থাৎ যে আগে পৃথিবীতে এসেছে সে ই ভবিষ্যৎ রাজা, আর ২য় ছেলেকে গোপনে নির্বাসিত করতে হবে। উপস্থিত সবাই এ কথায় সায় দিল। রাতের আধারেই এক সৈনিককে দিয়ে ২য় রাজপুত্রকে পাঠিয়ে দেয়া হলো নির্বাসনে, তবে ওর দেখভালোর জন্য রাখা হলো অভিজাত সেবিকা আর শিক্ষক। রানী প্রায়ই সেই বিশ্বস্ত সৈনিক কে পাঠাতেন ছেলের খবর নেয়ার জন্য। এই গোপন খবর ৪-৫ জন লোক জানত, তাদের মাঝে বর্তমানে বেঁচে আছে মাত্র দুজন, এক ধাত্রী আর সেই সৈনিক আরামিস। হঠাত একদিন শুনতে পেয়েছিল সেই হতভাগা রাজপুত্রের মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু এখন সেই বেঁচে থাকা ধাত্রীর কাছে শুনতে পেল ফিলিপকে এখন কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আরামিস তাই জীবনের রিস্ক নিয়ে কারাগারে গেল হতভাগার সাথে দেখা করতে। দেখা করে জানতে পারল কেনো তাকে এই অন্ধকার কুঠুরিতে নিক্ষেপ করা হল। রাজপুত্র বলল – সে কোন অপরাধ করেছে বলে মনে পড়ে না, তবে রানীর কাছ থেকে আসা একটা চিঠি সে একদিন পড়ে ফেলেছিল। সে কে কোনোদিন জানতে পারেনি, সেই চিঠিটা পরে শুধু বুঝতে পেরেছিল যে, সে খুব গুরুত্বপূর্ন কোনো লোকের সন্তান যার খোঁজ নিতে নিয়মিত চিঠি পাঠায় স্বয়ং রানী। এই চিঠি পড়াই তার জন্য কাল হলো, সেদিনই তাকে এই কারাগারে এনে বন্দি করা হল কোনো কারন ছাড়াই। আগে যাও সেই বাড়ির ভেতরের মুক্ত বাগানে একটু নিঃশ্বাস নিতে পারত, এখন সেটাও সম্ভব নয়। আরামিস তখন তাকে সব খুলে বলল, সে বর্তমান রাজার হতভাগ্য জমজ ভাই। তারপর আরামিস এক ভয়ংকর প্ল্যান ওকে বলল যে, কারাগার থেকে ওকে বের করে নিবে, আর রাজার সিংহাসনে বসাবে। রাজপুত্র ফিলিপ তখন অনুভূতিহীন, হঠাত নিজের পরিচয় পেয়েই বুঝে উঠতে পারছিল না। নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে পারছিল না আর সে কোনোদিন বাইরের জগত দেখতে পাবে এই ইচ্ছেটাও যেন মরে গিয়েছিল, কিন্তু তবুও সে আরামিসের কথায় নির্ভর না করে পারল না। আরামিস ওকে বোঝাল যে ওর ভাই ভালো রাজা নয়। তার ভাই এর জায়গায় সেই হতে পারে ফ্রান্সের উপযুক্ত রাজা। এভাবেই আরামিস তার গোপন প্ল্যানের সব আগাতে থাকল আর ফোকের বাড়িতে রাজার আগমনের আয়োজনও করতে লাগল। অনেক কসরত করে সুক্ষ্ম প্ল্যানের মাধ্যমে কারাগার থেকে বের করে আনল রাজপুত্র ফিলিপ কে। ছদ্মবেশে নেয়া হলো ফোকের বাড়িতে। অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিনও এলো। রাজা স্বপরিবারে এলেন ফোকের বাড়ীর নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে। আরও সব দাওয়াতি অতিথিরা এলো। ফোকের বাড়ির বিশালতা, আভিজাত্য আর আয়োজন দেখে রাজা অবাক না হয়ে পারল না, ভাবতে লাগল রাজা আসলে সে নাকি ফোকে!! খাওয়া দাওয়ার পর রাজার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো ঘুমানোর জন্য। কিন্তু রাজা শুধু ফোকের এই রাজপ্রাসাদ আর আভিজাত্যেই মগ্ন হয়ে ছিল, আর ভেবে মন বিষিয়ে উঠল যে, রাজকোষের টাকা দিয়ে সে এসব করে বসছে, একে বারতে দিলে কোনদিন আবার রাজার সিংহাসনও দখল করে বসবে। এটা ভেবেই রাজা দারতানিয়াকে ডাকল আর ফোকে কে গ্রেফতার করতে বলল। দারতানিয়া তো অবাক যে, আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসে গ্রেফতারি পরোয়ানা দেয়া কতটা ঠিক হবে। দারতায়া রাজাকে অন্তত রাত টুকু অপেক্ষা করে সকালে গ্রেফতারের আদেশ দিতে বলল। রাজা মেনে নিল। রাজা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল, আর রাতে হঠাত করেই মনে হলো সে স্বপ্নের মাঝেই ক্রমশ বিছানা সহ নিচে নেমে যাচ্ছে। আসলে সেটা স্বপ্ন ছিল না, সত্যিই ছিল। রাজার থাকার ব্যবস্থা আরামিস যে ঘরে করেছিল সেই ঘরটা কে ফোকে একটা সুরঙ্গের মতো করে বানিয়েছিল, বিছানার নিচের পাটাতন সরালেই বেরিয়ে পরত সুরঙ্গ পথ। সেই পথেই আরামিস, আর্থোস আর পর্থোস, এই থ্রী মাস্কেটিয়ার্স অপহরণ করল রাজাকে, দারতানিয়া কিছুই টের পেলো না। রাজাকে নিয়ে যাওয়া হলো কারাগারে। প্ল্যান মতো বন্দি করা হলো ফিলিপের জায়গায় রাজা চতুর্দশ লুই কে। রাজা পাগলের মতো অনেক চিৎকার চেচামেচি করল যে, সে রাজা তাকে ধরে এনে বন্দি করা হয়েছে। কিন্তু আরামিস এভাবেই প্ল্যান করেছিল যে, সবাই ওকে পাগলের কান্ড বলে এড়িয়ে গেল। রাজা ভেবেছিল ফোকেই তাকে বন্দি করেছে, কিন্তু সেই বেচারা তো কিছুই জানেনা। গতকাল রাতেও যে রাজা হয়ে ঘুমিয়েছিল, ঘুমের মাঝেই সে হয়ে গেল এক পাগল বন্দি!! আর রাজার জায়গায় স্থান পেল নতুন রাজা। কেউ জানল না শুধু থ্রী মাস্কেটিয়ার্স আর এই দুই বদলে যাওয়া রাজা ছাড়া। কিন্তু আরামিস ফোকে কে ডেকে যখনই এই সংবাদ জানাল, ফোকে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো!! তার বাড়ীতে মেহমান হয়ে এসেছে রাজা আর এখান থেকেই কিনা ওকে অপহরণ করা হলো!! কোনো ভাবেই এটাকে মেনে নিতে পারল না সে, দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে বেরিয়ে পড়ল কারাগারের উদ্দ্যেশ্যে। আর পালাতে বলল আরামিস, পর্থোস আর আথোসকে, অরা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল ফোকের দুর্ভেদ্য এক দুর্গের মাঝে । নতুন রাজা তার অনিশ্চিত এই শুরুর কথা ভেবে আর সারারাত ঘুমাতে পারলেন না। সকাল হলো, শুরু হলো তাকে শিখিয়ে দেয়া মতো করে রাজা হিসেবে তার অভিনয়। প্রথমে তার সাথে দেখা করতে এলো, তার মা অস্ট্রিয়া। মা কে দেখে কোনোভাবেই সে আবেগ নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল না। কন্ঠকে যতটা পারা যায় স্বাভাবিক রেখে কথা বলল মায়ের সাথে, কিন্তু হাজার হলেও তো মা, তার সন্তানকে ঠিকই চিনতে পারে। এই সময় এলো দারতানিয়া জানার জন্য যে ফোকে কে গ্রেফতার করবে কিনা, রাজা না করল। এতে দারতানিয়া অবাক হল। সেই সময়ই ফোকে আসল রাজাকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়ে হাজির হল। একি চেহারার দুই রাজাকে দেখে উপস্থিত সবাই চিৎকার করে উঠল, নতুন রাজা ফিলিপের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। কে আসল রাজা এটা যেন কেউ বুঝতে পারল না। রাজা লুই পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত খুলে দিল সব জানালার পর্দা, সূর্যের আলোয় ভরে গেল ঘর, তার মা কে ডেকে বলল, মা চিনতে পারছে কিনা। ওদের মা বেহুশের মতো পরে গেল, যেন বুঝেও বুঝতে চাইছেন না উনি। এইবার লুই ডাকল দারতানিয়া কে, “ক্যাপ্টেন ভালো করে তাকান আমাদের দিকে। দেখে বলেন কার চেহারা বেশি ফ্যাঁকাসে?” দারতায়া ঠিক চিনতে পারল, আর রাজার অনুগত সৈনিকের মতো ফিলিপের কাঁধে হাত রেখে বলল, “ আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করছি মসিয়ে। আমাকে ক্ষমা করবেন রাজপুত্র, আমি সৈনিক, আমার আনুগত্য একমাত্র তাকেই আমি দিয়েছি। তার সাথে শপথ ভাঙার মতো কোনো কারন এখনও ঘটেনি।“ হতভাগ্য রাজপুত্র ফিলিপের গলা থেকে শুধু এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, “একটা নতুন পৃথিবী, একটা নতুন জীবন আমি পেয়েও হারালাম। আমার শুধু দুঃখ হচ্ছে সাহসী সহৃদয় যে বনধুদের আমি পেয়েছিলাম তাদেরও হারাতে হচ্ছে। মসিয়ে দারতানিয়া নিয়ে চলুন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবেন।“ দারতানিয়া বেরিয়ে গেল ফিলিপ কে নিয়ে, বের হওয়ার পথে রাজার হাতে লেখা এক নির্দেশনা পেল, “মসয়ে দারতানিয়া, সেন্ট মার্গারিয়েট দ্বীপে রেখে আসবেন বন্দিকে। তার আগে তার মুখে একটা লোহার মুখোশ পরিয়ে দিবেন। বন্দি যদি কখনো সে মুখোসগ খুলে, তাহলে নিজের প্রানের ঝুঁকি নিয়ে খুলবে।“ এক মাঝরাতে দারতানিয়া বন্দি রাজপুত্রকে দ্বীপে নিয়ে যেতে আসল, আগে থেকেই নৌকা ঠিক করা ছিল। মাঝিরা এগিয়ে গেল বন্দিকে নামিয়ে আনার জন্য। কিন্তু বন্দিকে দেখে তারা চমকে উঠলো। এ যেন মানুষ নয়, মুখে ভয়ংকর এক কালো শিরোস্ত্রানে ডাকা বন্দির মুখ, শুধু জলজলে চোখগুলো দেখা যাচ্ছে এর ভেতর থেকে। দেখলেই গা শিউরে উঠে। বন্দিকে নৌকায় তুলে যাত্রা করল তারা দ্বীপের উদ্দেশ্যে। নৌকা দ্বীপে ভিড়তেই, আলতো করে বন্দির বাহু স্পর্শ করে ক্যাপ্টেন বলল, ‘আসুন মসিয়ে” “আমাকে আর মসিয়ে বলবেন না। আমাকে যদি কোনো নামে ডাকতেই হয় তবে ডাকবেন অভিশপ্ত বলে”, এমন এক স্বরে রাজপুত্র কথাটা বলল উপস্থিত প্রতিটি লোকের হৃদয়ে বিঁধল কথাটা। রাজপুত্র নিজে নিজেই নামল নৌকা থেকে, এগিয়ে গেল দ্বীপের গভর্নর মাথা নুয়ে কুর্নিশ করল বন্দিকে। আর এগিয়ে চলল দুর্গের ফটকের দিকে। ফটকের কাছে গিয়ে বন্দি একবার ফিরে তাকাল খোলা সাগরের দিকে। আবার ফিরে গিয়ে ধুকে পরল দুর্গে, বন্ধ হয়ে গেল লোহার দরজা। ক্যাপ্টেন মাঝিদের নির্দেশ দিল নৌকা ছাড়তে, কন্ঠ রুক্ষ শোনা গেলেও মাঝিরা বিদ্যুৎ চমকে যাওয়ায় দেখতে পেল ক্যাপ্টের চোখে জল টলমল করছে, এখনি যেন গাল বেয়ে নেমে আসবে। এরপর রাজা বিশাল সৈন্য বাহিনী পাঠাল থ্রী মাস্কেটিয়ার্সদের ধরার জন্য। সেই সৈন্যদের সাথে শেষ্মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে গিয়ে জীবন দিল এই বিখ্যাত তিন সৈনিক। দারতানিয়া বন্ধুদের মৃত্যু সংবাদ যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। রাজা ফোকে কেও গ্রেফতার করল। তারপর কেটে গেল ৪ বছর, দারতানিয়া রাজার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হল্যান্ড আক্রমণ করল। এক মাসে তার বাহিনী ১২টা দুর্গ দখল করে নিল, আরেকটা দুর্গ দখল করলেই তারা ফ্রান্সের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিতে পারবে। এমন সময় ছুটতে ছুটতে এলো এক অশ্বারোহী– রাজা চিঠি পাঠিয়েছেন, রাজা মার্শাল অফ ফ্রান্স খেতাবে ভূষিত করেছেন তাকে। দারতায়ার স্বপ্ন পূরন হলো, তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। ঠিক এই সময় শত্রুর দূর্গে গর্জে উঠল কামান। কিছু বোঝে উঠার আগেই সেটা আঘাত করল মার্শাল অফ ফ্রান্সের বুকে। হাতে থাকা কাঠের বাক্সটা ছিটকে পরল আর বেরিয়ে এলো “ফ্লেয়র দ্যা লি” আঁকা ব্যাটন টা, গড়াতে গড়াতে চলে এলো মার্শালের হাতে। একে আঁকড়ে ধরে উঠে বসার চেষ্টা করল পারল না। মুখ দিয়ে তখন শুধু অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এলো- “আর্থোস, পর্থোস, আরামিস আমি আসছি!” মারা গেলেন মহাবীর সৈনিক “মার্শাল অফ ফ্রান্স” দারতানিয়া। এই গল্পের শিক্ষাগুলো আমি আজ আর ব্যাখ্যা করব না, আপনাদের থেকেই জানতে চাইব। Like this:Like Loading... Related Spread the lovemoremore