কিশোর ক্লাসিক- “প্রবাল দ্বীপ” বুক সামারি & রিভিউ by খাতুনে জান্নাত আশা - September 1, 20210 Spread the lovemore কিশোর ক্লাসিক- “প্রবাল দ্বীপ” রবার্ট ব্যালান্টাইন রালফ রোভারের পূর্বপুরুষরা সবাই ছিলেন সাগরপ্রেমী। তাই তার রক্তে ছিল সাগর জয়ের নেশা। সাগরের প্রতি গভীর টান তাকে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই বাড়ি ছাড়া করেছিল জাহাজে চড়ে দূর সাগর পাড়ি দিয়ে অপার সৌন্দর্যঘেরা প্রবাল দ্বীপ স্বচক্ষে দেখার আকাঙ্ক্ষায়। রালফদের ‘অ্যারো’ নামক সৌদাগরি জাহাজ ভালোই চলছিল। জাহাজে সে নতুন দুজন বন্ধুকেও পেয়ে গেলো, নাম জ্যাক আর পিটারকিন। ঠিক প্রবাল দ্বীপটা যখন জাহাজ থেকে দেখতে পাওয়া গেল, ওই সমইয়টায়ই শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়, এক নাগাড়ে ৫ দিন ঝড় হওয়ার পর জাহাজ আর এই ঝড়ের প্রকোপ সইতে পারছিল না, ক্যাপ্টেন অবস্থা বেগতিক দেখে জাহাজ থেকে দ্রুত নৌকা নামাতে বললেন। ক্যাপ্টেন আর কয়েকজন নাবিক নৌকায় চড়ে বসল, হঠাত এক ঢেউ এসে কোথায় যেন তলিয়ে দিল মানুষগুলো সহ নৌকাটাকে।এদিকে রোভার, জ্যাক আর পিটারকিন কোন রকমে জাহাজের একটা দাড় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকল। জ্ঞান হারাল রোভার, আর কিছু সে জানেনা, জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে আবিষ্কার করল নরম ঘাসের উপর শোয়া অবস্থায়। জ্যাক আর পিটারকিনকে দেখতে পেল তার সেবা শুশ্রষা করছে। ভাগ্য ভালো তাদের , সাগরের ঢেউ তাদেরকে এই প্রবাল দ্বীপে এনে ফেলেছে। বুঝল তারা, রবিন্সন ক্রুসোর মতো আটকা পড়েছে একটা নির্জন দ্বীপে। কিন্তু ওরা এতে দুঃখ না পেয়ে বরং বেশ খুশি হল, ৩জন হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠল। দ্বীপে টিকে থাকতে হলে তাদের কি কি দরকার, কি করতে হবে তৎক্ষণাৎ ভেবে কাজে লেগে গেল তিন বন্ধু। খাবারের জন্য প্রথম কয়েকদিন নির্ভর করল সামুদ্রিক ঝিনুকের উপর, কাঠে কাঠ ঠুকে আগুন জ্বালানোর ব্যাবস্থাও করে ফেলল জ্যাক। এরপর দ্বীপ ঘুরে আরও অনেক খাবার পেয়ে গেল। নারিকেল,মিষ্টি আলু ,রুটিফল আর শুকরের মাংস দিয়ে তাদের আহার বেশ ভালোই চলছিল। এর মাঝেই একদিন দ্বীপ ঘুরে আবিষ্কার করল এখানে আগেও কেউ এসেছিল ,খুঁজতে খুঁজতে একটা কুড়ে ঘর পেয়ে গেল আর দেখল এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। বিছানার উপর একটা মানুষের কঙ্কালের উপর একটা কুকুরের কঙ্কাল। ভীষন কষ্ট পেল ওরা এই দৃশ্য দেখে। কুড়েটা ভেঙে ফেলে দিয়ে মনিব আর প্রভুভক্ত কুকুরের সমাধি করে দিল তারা। সেদিন আর ওরা কেউ খেতেও পারল না বিষন্নতায়। পরদিন থেকে আবার তারা নিজেদের কাজে লেগে গেল, জ্যাক শুরু করল নৌকা তৈরীর কাজ। পড়ুনঃ কিশোর ক্লাসিক- “ড. জেকিল ও মি. হাইড” একদিন দেখতে পেল দুইটা ক্যানো যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে অনেক জংলিদের নিয়ে ওদের দ্বীপের দিকে আসছে। একটা ক্যানো আরেকটাকে তাড়িয়ে আনছে মনে হলো। দুইটা ক্যানোই এসে থামল ওদের দ্বীপে আর ওরা সাক্ষী হলো এক জঘন্য দৃশ্যের। দুই ক্যানোর জংলিদের মাঝে তুমুল লড়াই, রক্তারক্তি ঘটার পর যারা তাড়িয়ে আনছিল ওরাই জয়ী হলো। বিপক্ষ দলের ১৪-১৫ জনকে বন্দী করল। আগুন জ্বালিয়ে সাথে সাথে এক বন্দিকে ধরে মাথায় আঘাত করে মেরে আগুনে জ্বলসিয়ে প্রায় কাঁচাই খেতে লাগল। এই কুৎসিত দৃশ্য দেখে ওরা বমি করতে শুরু করল। এই মানুষ খেকো জংলি তাদেরকে ধরতে পারলে কি অবস্থা করবে ভবেই শিউরে উঠল। এরই মাঝে কিছু জংলি যারা দৌড়ে দ্বীপের ভেতর পালিয়েছিল ওদেরও ধরে আনল,তার মধ্যে একটা মেয়ের কোলে ছিল ওর বাচ্চা। একটা জংলি কুৎসিত হাসি দিয়ে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিয়ে সমুদ্রের পানিতে ছুড়ে ফেলল, কিন্তু এই ভয়াবহতা হইয়ত সমুদ্রও সহ্য করতে পারল না, তাই বাচ্চাটাকে ভাসিয়ে নিল না। তীরে পরে কাঁদতে লাগল। আর বাচ্চার মা কে সর্দার গোছের জংলি যেন কি বলতে লাগল, ওকেও মনে হলো পুড়িয়ে মারা হবে। তার আগেই জ্যাক ওদেরকে বাঁচাতে চাইল। জ্যাক হাতে নিল মুগুর, রোভার আর পিটারকিনকে বলল বন্দিদেরকে মুক্ত করে দিতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৩জন ঝাপিয়ে পড়ল মানুষখেকো কুৎসিত এই জানোয়ারগুলোর উপর। বন্দিদের মুক্ত করার পর আবার শুরু হল তুমুল লড়াই এইবার বিপক্ষদল জিতে গেল। বিজেতা দল অদ্ভুত ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল ওদের প্রতি। ওরা ওদের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করল বিজেতা অতিথিদের, পরদিন ওরা বিদায় নেয়ার সময় ৩ সাহায্যকারীকে জোর করল ওদের সাথে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ওরা রাজি হল না প্রবাল দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যেতে। খুব ব্যস্ততায় আর আনন্দেই কেটে যায় তাদের দিন, তারপরও মাঝে মাঝে বাড়ির কথা মনে হলেই কষ্ট পায় তারা, ফিরে যেতে চায়। পাহাড়ে উঠে খোঁজ করতে থাকে নতুন কোনো জাহাজের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে আসে। জ্যাক অবশেষে একদিন নৌকা তৈরীর কাজ শেষ করল, ভাবল ওরা আশেপাশের দ্বীপগুলো থেকে ঘুরে আসবে এতে চড়ে, একটা পেঙ্গুইনের দ্বীপই ওদের বিশেষ আকর্ষন করল। ওরা অদ্ভুত এই পাখিগুলোকেই দেখতে যাবে ঠিক করল। খাবার দাবার নিয়ে নৌকায় চেপে রোনা হলো তারা। দ্বীপের কাছে এসে লক্ষ্য করতে লাগল পেঙ্গুইনদেরকে, অবাক হল এদের কান্ডকারখানা দেখে। পাখিগুলো ওদের দেখে কোনো পাত্তাই করছিল না, নির্দ্বিধায় নিজেদের মতো চলছিল। এদের দেখতে দেখতেই দ্বীপে নামার আগেই শুরু হলো তুমুল ঝড়। নৌকার নিয়ন্ত্রন হারাল ওরা অনেকটাই, পথ হারিয়ে কোনরকমে একটা টিলায় গিয়ে আশ্রয় নিল ,নৌকাকে অনেক সাবধানে সেটার সাথে বাঁধল। আরও পড়ুনঃ Uncle Tom’s Cabin By Harriet Beecher Stowe টিলার সাথে আবিষ্কার করল একটা গুহা, সেখানে তারা আশ্রয় নিল কোনোরকমে। গুহায় গিয়ে আগে খাওয়া দাওয়া করল, কারন সামনে আরও কি বিপদ আসবে তার ঠিক নেই, তার আগে খেয়ে নিতে চাইল। একনাগাড়ে কইয়েকদিন চলল এই ঝড়, আবার সাগর শান্ত হয়ে আসল। ওরা বের হয়ে এলো গুহা থেকে ,নৌকায় উঠে বসল। আবার পৌছাল তাদের পুরোনো সেই প্রবাল দ্বীপের আবাসে। ওরা দ্বীপে আরও নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজে নিতে চাইল, কারন জংলিরা যদি আবার এসে পরে তবে যেন ওদের অন্তত খুঁজে না পায়। একটা প্রবাল প্রাচীরে ঘেরা গুহাও পেয়ে গেল, সেখানে আশ্রয় নিল সব জিনিসপত্র নিয়ে। হঠাত একদিন তারা একটা জাহাজ দেখতে পেল। দ্রুত চিৎকার চেঁচামেচি আর লম্ফ জম্ফ করে তাদের উপস্থিতি জানান দিল। জাহাজ থেকে ওদের দেখতে পেল, তীরে ভেরাল জাহাজ, আর ওরা তখনই কালো পতাকাটা দেখতে পেল। বুঝতে পারল এটা জলদস্যুদের জাহাজ, দ্রুত লুকিয়ে পরল তারা। অনেক সময় পর রালফ রোভার দেখার জন্য বেরিয়ে আসল জাহাজটা এখনও আছে কিনা, বের হতেই ধরা পরে গেল ওদের হাতে, ওকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হলো সেই জাহাজে। তাকে জাহাজের কাজে লাগিয়ে দেয়া হলো। এখানে সে বিল নামের এক ছেলের দেখা পেল যাকেও এরা অপহরণ করে জাহাজের কাজে লাগিয়েছে, ওরা দুজন বন্ধু হয়ে গেল। জানতে পারল এই জাহাজে করে ক্যাপ্টেন জংলিদের দ্বীপ থেকে চন্দনকাঠ সংগ্রহ করে, তবে সেটা উপহারের বিনিময়ে না, ভয়ভীতি দেখিয়ে। এইবার যখন ক্যাপ্টেন জংলিদের ক্ষেপিয়ে দিল, আর পালানোর পথ পেলো না, ওদের হাতে মরতে হলো। বিল আর রোভার কোনো রকমে পালিয়ে এসে নৌকা নিয়ে জাহাজে উঠল, তাদেরকে তাড়া করে আসল কয়েকশ জংলি, কোনো রকমে জান নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে পারল তারা। কিন্তু বিলের অবস্থা শূচনীয়। ক্যাপ্টেন ওকে ভুল বুঝে গুলি করেছিল বুকে, সেটাই অকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে টেনে নিচ্ছিল। রোভার বিলের কাছে জানতে চাইল কি করে সে প্রবাল দ্বীপে ফিরে যেতে পারে, বিল ম্যাপ দেখে ওকে পথ বাতলে দিল, রোভার সেদিকে জাহাজের হাল ধরে নিয়ে এগিয়ে চলল। একদিন সে দেখল বিল আর বেঁচে নেই। খুব দুঃখ পেল। একাকী জাহাজ চালিয়েই প্রবাল দ্বীপে পৌছাল সে, বন্ধুরা তো ওকে ফিরে পেয়ে বেজায় খুশি। তারপর এই জাহাজে করেই ৩বন্ধু বাড়ির পথ ধরল। রবিনসন ক্রুসো, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন, নিঝুম দ্বীপে একা আর এই গল্পটার পটভূমি অনেকটাই এক, প্রতিকূলতার সাথে সার্ভাইভ করে টিকে থাকা এবং এই গল্পগুলোর মূল শিক্ষা হলো বিপদে ঘাবড়ে না গিয়ে, ঠান্ডা মাথায় এর মোকাবেলা করা। মানুষ তার প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে যে কোনো বিপদসংকুল পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে পারে। জীবনটা সহজ নয় কারো জন্যই, যারা সব প্রতিকূলতাকে জয় করে টিকে থাকতে পারে, দিন শেষে তারাই হয় প্রকৃত বিজেতা। Like this:Like Loading... Related Spread the lovemoremore